মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৩

রামপাল ইস্যু, জানুন তারপর সিদ্ধান্ত নিন

রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে চলছে কথার লড়াই, হচ্ছে আন্দোলন, লংমার্চ। আর এ নিয়ে অনেকটাই ধোঁয়াশার মাঝে আছে সাধারণ জনগণ। যদিও ইতিমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে প্রেসনোট জারি করে এই প্রকল্পের ব্যাপারে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পরিবেশ তথা সুন্দরবনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আন্দোলন করে যাওয়া তেল-গ্যাস-বন্দর- বিদ্যুৎ ও খণিজ সম্পদ রক্ষাকারী জাতীয় কমিটি তাদের এই প্রকল্প বন্ধের দাবি থেকেও সরে আসছে না।

২৪-২৮ সেপ্টেম্বর হয়ে যাওয়া লংমার্চ কর্মসূচি শেষে আগামী ১১ অক্টোবরের মাঝে এই প্রকল্প বাতিল করা না হলে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। সবমিলিয়েই একটা ধোঁয়াটে অবস্থার তৈরি হয়েছে এই প্রকল্প নিয়ে। এই নিয়ে বিভ্রান্তি কাটানোর জন্যই এই লেখার অবতারণা।

বাগেরহাট জেলার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসির সাথে বাংলাদেশের পিডিবির সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১০ সালে এবং চূড়ান্ত যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি হয় ২৯ জানুয়ারি ২০১২। এই প্রকল্পে দুই পক্ষেরই সমান অংশীদারিত্ব থাকবে। প্রকল্প খরচের ১৫ শতাংশ বহন করবে পিডিবি, ১৫ শতাংশ বহন করবে এনটিপিসি এবং বাকি ৭০ শতাংশ আসবে ঋণ থেকে।

সারা পৃথিবীতে ৪১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে সেখানে বাংলাদেশে কয়লা থেকে ১ শতাংশেরও কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় দৈনিক উৎপাদন ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে সরকার। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই।

একটি সাধারণ প্রশ্ন জাগতে পারে সবার মনে যে, কেন রামপালেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হলো। অন্য কোথাও নয় কেন? যেকোনো প্রকল্প চূড়ান্ত করার আগে নানা ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় এবং সম্ভাব্য সবচেয়ে উপযোগী জায়গাটাই বাছাই করা হয়। এই ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব, কয়লা পরিবহন সুবিধা, জমি পাওয়া, স্থানীয়দের পুনর্বাসন সবদিক বিবেচনা করেই রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে শিল্পের উন্নয়নের বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

২০৩০ এর মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য এরপর আনোয়ারা, মহেশখালী সহ উপকূলবর্তী আরো বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।

এবার আসুন জেনে নেয়া যাক, রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ব্যাপারে সম্ভাব্য বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর। প্রতিটি উত্তরই সহজ ভাষায় ও কারিগরি দিক বিবেচনা করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করি, এক নজর দেখলেই সবাই বুঝতে পারবেন।

প্রশ্ন ১. প্রস্তাবিত প্রকল্পটি কি সুন্দরবন এবং ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত? এই প্রকল্পটি কি এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন রুলস (ECR) ১৯৯৭ এর পরিপন্থী?
উত্তর:
প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সুন্দরবনের নিকটতম সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার এবং নিকটতম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট থেকে ৬৯.৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ‘এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন রুলস (ECR) ১৯৯৭’ এর মোতাবেক কোনো স্থাপনা সুন্দরবনের সীমানার ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে নির্মাণ করা যাবে না। এই ১০ কিলোমিটার জায়গাকে ‘ইকোলজিকেলি ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেহেতু প্রস্তাবিত প্ল্যান্ট এর দূরত্ব সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, সেহেতু এই প্রকল্প ‘ECR-1997’ এর সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ।


প্রশ্ন ২. প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রকল্পের চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া কি স্থানীয় এলাকার তাপমাত্রায় কোনো প্রকার প্রভাব ফেলবে?

উত্তর: না। চিমনি থেকে নির্গত ‘ফ্লু-গ্যাস’ এর তাপমাত্রা হবে সর্বোচ্চ ১২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড যা অন্যান্য সমসাময়িক প্রযুক্তি থেকে অনেক কম। পরিবেশ অধিদফতরের মান অনুযায়ী চিমনির মুখ ২৭৫ মিটার উচ্চতায় রাখার কারণে এই ফ্লু-গ্যাসকে সহজেই বায়ুমণ্ডলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। যেহেতু প্রস্তাবিত প্রকল্পের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ভৌগলিক প্রতিবন্ধক নেই, যেমন পাহাড়-পর্বত, উঁচু দালান বা ঘনবসতি, সেহেতু উষ্ণতা আটকা পড়ে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।

প্রশ্ন ৩.
ক) মজুদ করে রাখা কয়লা থেকে সূক্ষ চূর্ণ (কোল ডাস্ট) কি আশেপাশের এলাকায় বা স্থানীয় জনসাধারণ পর্যন্ত পৌছাবে?
খ) কয়লা পরিবহনের সময় সূ
ক্ষ চূর্ণ (কোল ডাস্ট) কি হাওয়ায় মিশে সুন্দরবনের বাতাস দূষিত করবে?


উত্তর: না। প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিভিন্ন স্তরে (যেমন কয়লার টার্মিনাল, স্টক ইয়ার্ড, মূল প্রকল্প ও অ্যাশ ডিসপোজল পণ্ড) অত্যাধুনিক ‘ডাস্ট সাপ্রেশন সিস্টেম’ থাকবে যা সয়ংক্রিয় সেন্সর এর মাধ্যমে বাতাসে ছাই এর পরিমাণ তদারক এবং নিয়ন্ত্রণ করবে। কনভেয়র বেল্ট (যা দ্বারা কয়লা প্রকল্পের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা হবে) সম্পূর্ণভাবে আবৃত বা ঢাকা থাকবে। স্থানান্তরের জায়গাগুলোতে ‘ওয়াটার স্প্রিন্কলার’ (পানি ছিটানোর যন্ত্র) থাকবে। ‘ওয়াটার স্প্রিন্কলার’ যখনই দরকার তখনই নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে ‘ওয়াটার স্প্রিন্কলার জেট’ থাকবে। যেখানে কয়লার মজুদ রাখা হবে (স্টক ইয়ার্ড), সেই পুরো এলাকা সয়ংক্রিয় আর্দ্রতা সেন্সর সম্বলিত ‘ওয়াটার স্প্রিন্কলার’ এর আওতায় থাকবে। সুতরাং, জাহাজের খোল থেকে, বা কয়লা নামানোর সময়, বা মজুদ থেকে অথবা কনভেয়র বেল্ট থেকে সূক্ষ চূর্ণ আশপাশের এলাকায় বা সুন্দরবনে পৌঁছানোর সম্ভবনা নেই বললেই চলে।

প্রশ্ন ৪. বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ছাই আশপাশের জনবসতি কিংবা সুন্দরবনের বায়ু দূষিত করবে কি?
উত্তর: না। শক্তিশালী ‘ইলেক্ট্রোস্টেটিক প্রেসিপিটেটর’ (ESP) যন্ত্র লাগানো হবে যার ফলে উৎপন্ন ফ্লাই অ্যাশ এর ৯৯.৯% গ্যাসীয় জ্বালানি থেকে শোষণ করে নেয়া যাবে। এই ESP ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি থেকে ফ্লাই অ্যাশ নির্গমনণ ১০০ মাইক্রোগ্রাম/ Nm³ এ কমিয়ে আনবে। এই মাত্রা ECR 1997 এর নির্ধারিত মানদণ্ড ২০০ মাইক্রোগ্রাম/Nm³এর চেয়ে অনেক কম। একইভাবে চুল্লির তলায় জমা হওয়া ছাইও (বটম অ্যাশ) স্বয়ংক্রিয় অ্যাশ কালেকশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের দ্বারা সরিয়ে ফেলা হবে।

প্রশ্ন ৫. সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমণ কি আশপাশের বায়ুর স্বাভাবিক গুণাগুণ নষ্ট করবে?
উত্তর: না। সকল গ্যাসের নির্গমণ হার পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্ব ব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। প্রস্তাবিত বিদ্যুত কেন্দ্র হতে সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইডের নির্গমণ হার হবে যথাক্রমে- ৮১৯g/s এবং ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম/Nm³। যেখানে বিশ্বব্যাংকের মানদন্ড অনুযায়ী ১৫৯৭g/s এবং ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম/Nm³পর্যন্ত নিরাপদ। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেষ্টণকারী পরিবেশের বায়ুর ওপর এই গ্যাসের প্রভাব হবে নগণ্য। এছাড়া বছরের বেশিরভাগ সময় বাতাসের প্রবাহ থাকে উত্তরমুখী,যেখানে সুন্দরবন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। তাই সুন্দরবনে বায়ু দূষণের সম্ভাবনাও খুবই কম।

প্রশ্ন ৬. নির্গত ছাই কি আমাদের দেশে কোন কাজে ব্যাবহার করা যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ। বর্তমানে আমাদের দেশের সিমেন্ট কারখানাগুলোতে প্রতিবছর ২.১ মিলিয়ন টন ছাই প্রয়োজন হয়। ২০২০ সাল নাগাদ এই চাহিদা দাঁড়াবে ৩.৭৫ মিলিয়ন টন। প্রস্তাবিত বিদ্যুত কেন্দ্র হতে প্রতি বছর উৎপাদিত ছাইয়ের অনুমিত পরিমাণ ০.৭৫ মিলিয়ন টন। তাই উপজাত ছাই সহজেই সিমেন্ট কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যাবহার করা যাবে। এছাড়াও এই ছাই সার হিসেবে, মাটি ও বালির সাথে মিশিয়ে বাঁধ তৈরি, মাটি ভরাট ও ইট তৈরিতে কাজে লাগানো সম্ভব।

প্রশ্ন ৭. গ্লোবাল ওয়ারমিং বা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কমিকা হবে?


উত্তর: প্রস্তাবিত বিদ্যুত কেন্দ্রে সুপারক্রিটিকাল বয়লার প্রযুক্তির ব্যাবহার করা হবে যেখানে পানিকে উত্তপ্ত করে বিদ্যুত উপাদন করা হবে। এ প্রযুক্তি ব্যাবহারের ফলে প্রস্তাবিত বিদ্যুতকেন্দ্রটি বছরে প্রায় ৭.৯ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করবে, যা প্রচলিত কয়লাভিত্তিক প্রযুক্তির বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে ১০ শতাংশ কম। প্রস্তাবিত বিদ্যুতকেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনার কারণে জাতীয় কার্বন নির্গমণের বৃদ্ধির পরিমাণ অতি সামান্য হবে বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলস্বরূপ প্রচলিত কয়লাচালিত তাপীয় বিদ্যুতকেন্দ্র অপেক্ষা এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবহাওয়ার তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কম ভূমিকা থাকবে। তবে, কার্বন নির্গমনের ক্ষতিপূরণস্বরূপ সবুজ বেষ্টনী (গ্রীন বেল্ট) স্থাপন করা হবে, অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশে বন, খোলা মাঠ, গাছপালার জন্য নির্দিষ্ট জমির ব্যাবস্থা করা হবে।

প্রশ্ন ৮. বিদ্যুকেন্দ্রটি কি ভারী ধাতু নির্গমন করবে?
উত্তর: না। কয়লায় ভারী ধাতুর ঘনত্ব খুবই সামান্য। ভারী ধাতুর মৌলিক অংশ কয়লার ছাইয়ের মধ্যেই রয়ে যাবে, পরবর্তীতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেই ছাই নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশনের ব্যাবস্থা করা হবে। সুতরাং, ভারী ধাতু দ্বারা পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনা অনেক কম।

প্রশ্ন ৯. বিদ্যু
কেন্দ্রটির জন্য কি এ্যাসিড রেইন বা ক্ষারীয় বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে?

উত্তর: এ্যাসিড রেইনের কোনো সম্ভাবনা নেই। যেহেতু প্ল্যান্টটির চারপাশে ২০ কিমি পর্যন্ত কোন ভূখন্ডের প্রভাব এবং বিল্ডিং, জনবহুল শহরের মত বাধা নেই তাই জ্বালানী ও অন্যান্য কার্য পরিচালনা করার জন্য সৃষ্ট দূষিত ধোয়া (এসিড বৃষ্টি ঘটাতে সক্ষম এমন দূষিত পদার্থ) সহজেই অপসারণ করা যাবে।

প্রশ্ন ১০. মইদারা ও পশুর নদী ভরাট বা দখলের কোনো পরিকল্পনা কি আছে?
উত্তর: না। উল্লেখিত ২টি নদীর একটিরও কোন অংশ দখল করা হবে না। বরং, পশুর নদী ড্রেজিং-এর মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি করে নদীপথে যাতায়াত ব্যাবস্থা উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

প্রশ্ন ১১. সুন্দরবনে/আকরাম পয়েন্টে কয়লার মজুতঘর বানানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে?
উত্তর: না। সুন্দরবনের কোনো এলাকাতে এবং ইকলজিক্যালি ক্রিটিকাল এরিয়াতে কয়লার মজুতঘর স্থাপন করা হবে না। কয়লার মজুতঘর প্ল্যান্ট সাইটে নির্মাণ করা হবে।

প্রশ্ন ১২. সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে কয়লা পরিবহন কি সুন্দরবনের ক্ষতি করবে?
উত্তর: না। কয়লা পরিবহন করা হবে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমানে প্রচলিত নৌপথ দিয়ে। কয়লা পরিবহনের উদ্দেশ্যে সপ্তাহে শুধুমাত্র একটি বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল) আকরাম পয়েন্টে আসবে এবং প্রকল্পের নির্ধারিত স্থানে মালবাহী বড় নৌকার সাহায্যে কয়লা খালাস করবে যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (ECR)-১৯৯৭, আন্তর্জাতিক নৌ-সংস্থা (IMO)কনভেনশন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

প্রশ্ন ১৩. পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে উত্তপ্ত পানি নির্গত হবে কি?
উত্তর: না। বিদ্যুৎ প্রকল্পের নকশা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে উত্তপ্ত পানি বন্ধ থাকা অবস্থায় চক্রাকারে ঘুরে ক্রমান্বয়ে ঠান্ডা হবার পর নির্গমন হবে এবং কোনভাবেই উত্তপ্ত পানি সরাসরি নদীতে নির্গত হবে না।

প্রশ্ন ১৪. এই প্রকল্পের কারণে পশুর নদীর পানি দষিত হবার সম্ভাবনা আছে কি?
উত্তর: পাওয়ার প্ল্যান্টের কারণে পাশুর নদীর পানির গুণগত মান পরিবর্তিত হবে না, কারণ-
*একটি সমন্বিত পানি এবং বর্জ্য পানি শোধনাগার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে।
* ময়লা পানি পুনর্ব্যাবহারের (রিইউজ) লক্ষ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ (রিসাইক্লিং) প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন হবে।
* প্রকল্পটি এমনভাবে সাজানো হবে যাতে এখান থেকে কোনো বর্জ্য পদার্থ এবং ময়লা পানি অব্যাবস্থাপনায় নির্গত না হয়।
* কোনভাবেই উত্তপ্ত পানি সরাসরি নদীতে নির্গত হবে না।

প্রশ্ন ১৫. ঐখানে কি কোনো কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হবে যার ফলে বায়ুমণ্ডল এবং সুন্দরবনের উপর প্রভাব পড়বে?
উত্তর:
 কালো ধোঁয়া এবং বাস্প তৈরির সম্ভাবনা খুবই কম, কেননা-

*এটি ECA ১৯৯৫ এর দূষণকারী কেন্দ্রীকরণ মান নিশ্চিত করে।

* জ্বালানি গ্যাস বায়ুমণ্ডলের স্তর হতে ২৭৫ মিটার উপর থেকে নির্গত হবে যা কালো ধোঁয়াশা কাটাতে সহায়ক।
* প্রকল্পের আশপাশে কোনো ভৌগলিক বাধা নেই যেমন- পাহাড়, ঘনবসতি শহর যা প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
* ঘূর্ণিঝড় এবং নিম্নচাপ (সাধারণত যে অঞ্চলে হয় ) এর কারণে দীর্ঘমেয়াদে দূষিত পদার্থ আটকে গিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে বায়ুদূষণ ঘটাতে সক্ষম হবে না।

প্রশ্ন ১৬. পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কি রপ্তানী হবে?
উত্তর: না। তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং তখন বিদ্যুৎ রপ্তানি করা যাবে।

এখন কথা হচ্ছে, এই সহজ ব্যাপারগুলো এই প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করা মানুষগুলো বুঝেন না? না কি বুঝেও না বুঝার ভান করছেন, মানুষের আবেগকে পুঁজি করে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে চাচ্ছেন?  উল্লেখ্য এর আগেও সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে একই গোষ্ঠী যার অধিকাংশই ছিল অযৌক্তিক।

এই আন্দোলনে ইতোমধ্যেই সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। তাহলে কি ভোটের রাজনীতির মারপ্যাঁচে এবং গুটিকতক মানুষের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বন্ধ হয়ে যাবে আরেকটি উন্নয়ন প্রকল্প?

যেকোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লাভবান জনগণই হবে, আর তা না হলে ক্ষতিটাও জনগণেরই হবে। তাই সময় হয়েছে আমাদের সবার সচেতন হওয়ার। বিভিন্ন অজুহাতে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কাজে বাঁধাদানকারী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের বয়কট করার।

মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

একজন অহংকারীর পতন




পবিত্র কুরআন মাজীদে সূরা বনী ইসরাইলে আল্লাহ পাক বলেছেন, পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না। সূরা লোকমানে বলা হয়েছে, অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। অন্যান্য সব ধর্মগ্রন্থেও অহংকারকে মানবচরিত্রের একটি নিকৃষ্টতম দিক হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। কথায় বলে, অহংকার পতনের মূল। কিন্তু তারপরও অর্থ-সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা মানুশরুপী কিছু হায়েনাকে প্রায়শই অহংকারী করে তোলে। যেমনটি করেছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। 
 
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকাচৌ। চট্টগ্রামের রাউজান থেকে টানা ছয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং খালেদা জিয়ার এক সময়ের রাজনৈতিক উপদেস্টা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের রাউজান, গহিরা, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি এলাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সাথে নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী। গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুন্ঠনসহ এমন কোন হীন অপরাধ নেই যা তারা করেনি। আজ এই জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের রায় হয়েছে ফাঁসি। এর মাধ্যমে শুধু একজন ঘৃণ্য অপরাধীই সাজা পেল না, একজন দাম্ভিক-অহংকারীরও পতন হল।
সালাউদ্দিন কাদের চোধুরীই সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অহংকারী ব্যক্তি। অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলতে তার জুড়ি ছিল না। তার বাক্যবাণ থেকে রক্ষা পায়নি নিজদলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে আদালতের বিচারক পর্যন্ত। সকল নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিনিয়ত সেচ্ছাচারী ব্যবহার করে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু এর জন্য কখনোই তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। আর একারণেই বারবার দাম্ভিকতার চূড়ান্ত প্রদর্শনী দেখাতে পেরেছিলেন তিনি। আজ ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে চূর্ণ হল তার সব দম্ভ, সব অহংকার। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় সে একজন ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবেই লিপিবদ্ধ থাকবে। এর বেশি কিছু না। আসুন সালাউদ্দিন কাদের চোধুরীর অহংকারী আচরনের কিছু নিদর্শন দেখে নেয়া যাক।  
২০০১ সালে ওআইসি মহাসচিব পদে বাংলাদেশ থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয় তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার। এই উদ্যোগ ছিল বিশ্ব পরিমন্ডলে একজন যুদ্ধাপরাধীকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি হীন অপচেষ্টা মাত্র। তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামীলীগ এর বিরোধিতা করে বলেছিল  একজন যুদ্ধাপরাধী ও আন্তর্জাতিক সোনা চোরাকারবারিকে সরকার এই পদে মনোনয়ন দিয়ে বরং এই পদকে কলঙ্কিত করছে এবং আমাদের সামনে ওআইসি মহাসচিব পদ পাওয়ার সুনিচিত পথটিও সরকার হারাচ্ছে। সরকার যদি ঐ পদে ওরে বাদ দিয়ে বিএনপির মধ্যে যোগ্যতম অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয় তাহলে আমরাও সহযোগিতা করব। কিন্তু সাকা চৌধুরীর একগুয়েমি আচরণের কারণে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। সাকা চৌধুরীকে নির্বাচিত করতে প্রায় ২০০ কোটি খরচ করে লবিং করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। উপরন্তু এই ঘটনার জের ধরে মালয়েশিয়ার সাথে বন্ধুত্যে ফাটল ধরে কারণ মহাসচিব পদে মালয়েশিয়ারও প্রার্থী ছিল। মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশীদের জন্য। সাকা চৌধুরীর অহংকারের মূল্য চুকাতে হয় রাষ্ট্রের ক্ষতি করে।
পবিত্র সংসদে দাড়িয়েও একের পর কে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন সাকা চৌধুরী। সংসদে দাঁড়িয়ে সাকা চৌধুরী একবার বলেছিলেন, মাননীয় স্পীকার আমি তো *দনা হয়ে গেলাম। তার এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ  করার কথা বললে সাকা চৌধুরী বলে উঠেন, মাননীয় স্পীকার আমি আবারও *দনা হয়ে গেলাম। পঞ্চম সংশোধনী হওয়ার পর সাকা চৌধুরী সংসদে দাঁড়িয়ে এতো নোংড়া উক্তি করেন যা এখানে লিখাও সম্ভব নয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০০১ সালে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএনপি। এর জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এতোদিন জানতাম কুকুর লেজ নাড়ায়। এখন তো দেখছি লেজ কুকুড় নাড়াচ্ছে। বিগত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে সম্পদের হিসাব চাইলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেছিল ওদের কাছে কি জবাবদিহি করব ? ওদের কে তো চাকরি দিয়েছি আমরাই। ওরা আমাদেরকে জি স্যার, জি স্যার করত। এদের কথার আবার কিসের জবাব ? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য সংসদে আইন পাশ করা হলে সাকা চৌধুরী বলেছিলেন, এ আইনের নাম হওয়া উচিত ছিলো মালেকুল মউত আইন। শেখানে হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন সাকা চৌধুরী। ১/১১ পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হওয়ার সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছিলেন, ধর্ষণ যেখানে নিশ্চিত সেখানে উপভোগ করাই শ্রেয়।
মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর আসামীর কাঠগড়ায় দাড়িয়েও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একের পর এক কটুক্তি করে গিয়েছেন প্রসিকিউটর ও বিচারকদের প্রতি। এমনকি জেলখানায় থাকার সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের হয়। বিচারকাজের একদম শুরুর দিকেই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছিল, আমি রাজাকার। আমার বাপ রাজাকার। এখন কে কি করতে পারেন করেন। রায় পড়ার সময়ও সারাক্ষণই সাকা চৌধুরী হাসছিলেন এবং বিভিন্ন মন্তব্য করছিলেন। ৩ নম্বর অভিযোগ পড়ার সময় তিনি বলেন, ৩০ লাখ তো মারা গেছে। বলে দিলেই হয়, আমি ২০ লাখ মেরেছি। আরেক বার তিনি বলেন, তোমার বোনকে বিয়ে করার কথা ছিলো, সেটা বল না? হু ধানের কল চুরি করছি ঘরে ঢুকছি তারপর কি করছি বল। লাল মিয়া, সোনা মিয়া বল, পাঁচ কেটে ছয় করার দরকার? মিয়া তো ঠিকই আছে। এ সব মন্তব্য থেকেই প্রমাণিত হয় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার কৃতকর্মের জন্য বিন্দুমাত্রও অনুতপ্ত নয়। আরও প্রমাণিত হয় সে আসলে মানুষ নয়, মানুষরুপী হিংস্র নরপিশাচ।  

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন জাতি দায়মুক্ত হল অপরদিকে এই রায় হয়ে থাকল সকল অহংকারীর প্রতি এক বাস্তব শিক্ষা। পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিণতি দেখে আমাদের সবারই শিক্ষা নেয়া উচিৎ। অহংকার এবং দাম্ভিকতা পরিহার করা উচিৎ। কেননা অহংকার আসলেই পতনের মূল। আর এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।