রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

খুলনার জনসভায় খালেদা জিয়ার ভাষণঃ মিথ্যাচারের এক অনবদ্য প্রদর্শনী

খুলনার সার্কিট হাউজ মাঠে আঠারদলীয় জোট আয়োজিত জনসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার দেয়া ভাষণ শুনলান। কোন নতুনত্ব নেই। আছে শুধু সরকার তথা আওয়ামীলীগের প্রতি একগাদা বিষেদাগার। সেই বিষেদাগার করতে গিয়ে উনি এমন কিছু মিথ্যাচার করলেন যা উনার মত দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে কখনোই কাম্য হতে পারে না। আসুন দেখা যাক উনার বক্তব্য আসলে কতটা বাস্তবতা বিবর্জিত ছিল।

বক্তৃতার একদম শুরুতেই খালেদা জিয়া বললেন, আওয়ামীলীগ দেশের পাটশিল্প ধ্বংস করেছে। এধরণের মিথ্যাচার আমি নিকট অতীতে কোন নেতার কাছ থেকে শুনিনি। বাস্তব চিত্রটা আসলে কি?
১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জুট সেক্টর এডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট-এর আওতায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে তৎকালীন বিএনপি সরকার, যাতে বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ হতে  ২৪৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সেই চুক্তির শর্ত  মোতাবেক তৎকালীন বিএনপি সরকার স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় দেশের পাঁচটি পাটকল। এগুলো হল ময়মনসিংহ জুট মিল, বাওয়ানি জুট মিল, মনোয়ার জুট মিল, পূর্বাচল জুট মিল ও হাফিজ টেক্সটাইল। এমনকি ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ৩০ জুন বন্ধ করে দেয়া হয় এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল। একইসঙ্গে বন্ধ করা হয় খুলনার দৌলতপুর জুট মিল ও টঙ্গীর নিশাত জুট মিলআওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাট শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলতে নানা পরিকল্পনা গ্রহন করে। যার আওতায়-৫ মার্চ,২০১১ সালে পিপলস জুট মিল চালু করা হয় খালিশপুর জুট মিল নামে; ৯ এপ্রিল, ২০১১ সালে সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কওমী জুট মিল চালু করা হয় জাতীয় জুট মিল হিসেবে; ২৬ জানুয়ারি,২০১৩ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় অবস্থিত কর্ণফুলী জুট মিল ও ফোরাত-কর্ণফুলী জুট মিল চালু হয়। এছাড়া সরকার পাটচাষিদের কাছে পাটের উন্নত বীজ ও সার পৌছানোর ব্যবস্থা করেনিশ্চিত করা হয় পাটের ন্যায্য মূল্য। ফলে কৃষকরা নব উদ্যমে পাট চাষে ঝুঁকছেন। পাটের সোনালী ঐতিহ্য ফিরে আসা শুরু হয়েছে। এই সরকারের আমলেই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীবন রহস্য উদঘাটিত করছেন। পাট এখন আক্ষরিক অর্থেই আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি।

এরপর খালেদা জিয়া বললেন
বললেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশ লোক নেয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোন দেশ নাকি বাংলাদেশ থেকে লোক নিচ্ছে না। অথচ উনি মনে হয় জানেন না যে বিগত জোট সরকারের তুলনায় বর্তমানে দেশের রেমিট্যান্স বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর বেশিরভাগটাই এসেছে শ্রম রফতানি থেকে। গত সরকারের সময়ে বন্ধ হওয়া অনেক শ্রম বাজার একে একে খুলতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকারসরকারি ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো শুরু হয়েছে। অল্প টাকাতেই শ্রমিকরা এখন বিদেশ যেতে পারছেনঅচিরেই কাতার এবং সৌদি আরবেও শ্রমিক পাঠানো শুরু হবে।

খালেদা জিয়া বললেন, বিগত জোট সরকারের আমলে সীমান্তে একটা গুলিও চলে নি
বিএসএফ এর হাতে নাকি কেউ মারা যায়নি উনি এত সহজে অতীতের কথা ভুলে যান কিভাবে? বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা লিখে গুগলে সার্চ দিলেই যে কেউ দেখতে পাবে সীমান্তে কোন আমলে কতজন নিহত হয়েছে। সংখ্যাটা বলে দিচ্ছি। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে নিহত হয়েছেন ৪৩৬ জন বাংলাদেশী। আর বর্তমান সরকারের আমলে এখন পর্যন্ত সীমান্তে নিহত হয়েছেন ২৩৭ জন। 

খালেদা জিয়া বললেন, দেশে কোন বিদ্যুৎ নেই
এই সরকার নাকি জনগণকে বিদ্যুৎ দিতে পারছে না। আসুন বাস্তবতাটা জেনে নিই। বিগত জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রতিদিন ৪২০০ মেগাওয়াট। আর বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৮৭০০ মেগাওয়াট। গড়ে প্রতিদিন ৬৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে যা গত সরকারের তুলনায় দ্বিগুণ। তাছাড়া গত সরকারের আমলে তারেক জিয়ার খাম্বা দুর্নীতির কথা এখানে নাইবা তুললাম। শুধুমাত্র খাম্বা দুর্নীতির মাধ্যমেই তারেক জিয়া হাতিয়ে নিয়েছিলনে ২০০০ কোটি টাকারও বেশি।  

এরপর খালেদা জিয়া বললেন, এই সরকার কৃষকদের মূল্যায়ন করেনি, দারিদ্র্যতা কমায়নি
বিরোধদলীয় নেত্রী আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আপনার সরকারের আমলে সারের দাবিতে আন্দোলন করা কৃষকদের উপর গুলি চালানো হয়েছিল। সেচের জন্য বিদ্যুতের দাবিতে বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আর বর্তমান সরকারের গত পৌনে পাঁচ বছরে দেশের কোথাও সারের দাবিতে আন্দোলন হয়নি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের কাছেও সরকার সার পৌছে দিতে পেরেছে। সেচের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। আর তাই দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণচাইলে খাদ্য এখন বিদেশে রফতানীও করা যাবে। আর দারিদ্র্যতা বিমোচনের কথা বলছেন? দারিদ্র বিমোচনের জন্য বর্তমান সরকারের গৃহীত প্রকল্প সারা বিশ্বে উন্নয়ন মডেল হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। এই সরকারের সময়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে শতকরা দশ ভাগেরও বেশি। এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল।   

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে খালেদা জিয়া বললেন এই নির্বাচন কমিশন নাকি একটাও নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন করতে পারেনি
কি ধরণের ভিত্তিহীন মিথ্যাচার এটা ? এই সরকারের আমলে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রায় আট হাজার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোথাও কারচুপির অভিযোগ উঠেনি। এমনকি সর্বশেষ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছে। তারপরও কিভাবে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ? আপানাদের সময়ে হওয়া মাগুরা উপনির্বাচন ও ঢাকা-১০ আসনেরর উপনির্বাচনের কথা কিন্তু আমরা ভুলিনি। আপনি বললেন ভোটার তালিকায় নাকি ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আপনি ঠিক কোন আমলের কথা বলছেন তাই বুঝতে পারলাম না। আপনাদের সময়ে করা ভোটার তালিকার এক কোটি চল্লিশ লাখ ভুয়া ভোটারের কথা কিন্তু আমাদের দিব্যি মনে আছে

খালেদা জিয়া বক্তৃতায় দাবি করলেন, উনাদের সময় নাকি কোন জঙ্গীবাদ হয় নাই। সব নাকি আওয়ামীলীগ আমলে হয়েছে। তাহলে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা কি ছিল? বাংলা ভাই,শায়খ আব্দুর রহমান, মুফতী হান্নানরা কি ছিলেন? ব্রিটিশ হাই কমিশনার এর উপর বোমাহামলা কি ছিল? আদালতে বোমা মেরে বিচারক হত্যা কি ছিল? ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা কি ছিল? এইগুলো যদি আপনার চোখে জঙ্গীবাদ না হয় তাহলে তো আর কিছু বলার নেই
বিগত জোট সরকারের আমলে কোন দুর্নীতি ছিল না বলে দাবি করলেন খালেদা জিয়া। অথচ সেইসময়েই বাংলাদেশ পর পর পাঁচবার দুর্নীতিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০ তম।

পুরা বক্তৃতা জুড়ে আওয়ামীলীগের বিষেদাগার করে শেষ পর্যায়ে খালেদা জিয়া বললেন বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতিক করে না। ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে কি হিসেবে চিহ্নিত করবেন আপনি? শাহ কিবরিয়া, আইভী রহমান, আহসানউল্লাহ মাস্টার সহ হাজার হাজার আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীকে হত্যা তাহলে কি ছিল ?

খালেদা জিয়ার পুরোটা বক্তৃতা শুনে মনে হল দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই। বক্তৃতা দিতে হয় তাই দিয়েছেন। কিন্তু জনগণ এখন অনেক সচেতন। কে কি কাজ করেছে তার খতিয়ান সবারই মনে আছে। এতো তাড়াতাড়ি ভুলি কিভাবে ?


Top of Form

শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

শেখ হাসিনাঃ যার মাঝে খোঁজে পাই জাতির পিতাকে


কখনো তিনি মমতাময়ী মাতা, কখনো তিনি স্নেহময়ী ভগিনী। এই দুখী বাংলার মানুষকে তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদের মতই ভালোবাসেন, দিনরাত তাঁদের কল্যাণে কাজ করে যান। পরম মমতায় আগলে রাখেন তাঁর সংগঠনের প্রতিটি নেতাকর্মীকে। আবার তাঁর দৃঢ় ও অবিচল রুপটিও প্রায়শই দেখতে পাই আমরা। দেশের যেকোন সমস্যাই নিঃশঙ্কচিত্তে নির্ভয়ে মোকাবেলা করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার সংগ্রামে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেনএকজন দক্ষ মাঝি যেমন প্রচন্ড ঝড়ের মাঝেও নৌকাকে তীরে পৌছে দেয়, ঠিক তেমনি করে এই মানুষটিও বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছেন সাফল্যের বন্দরে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে তাঁর প্রশংসা ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বব্যাপী। হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার কথাই বলা হচ্ছে। আজ এই মহান মানুষটির ৬৭ তম জন্মদিন। জন্মদিনের এইক্ষনে বিবার্তা পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে  জানাই প্রাণঢালা অভিবাদন ও শুভকামনা।  

১৯৪৭ সালের ২৮ই শে সেপ্টেম্বর বেগম ফজিলাতুন্নেসা কোল আলো করে জন্ম গ্রহন করেন এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান। বাবা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নাম রাখেন শেখ হাসিনা। যদিও হাসু নামেই বেশি ডাকা হত তাঁকে। বাবার সান্নিধ্য খুব বেশি পাওয়া হয়নি তাঁর। মায়ের কাছেই বেড়ে উঠা। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বাবার প্রতিটা কার্জক্রম অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন শেখ হাসিনা। এভাবেই দেশ, দেশের মানুষ ও রাজনীতির প্রতি তাঁর ভালোবাসা গড়ে উঠে। পড়াশোনা করেছেন আজিমপুর গার্লস স্কুল, বদরুন্নেসা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী থাকা অবস্থাতেই তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন পুরোটা সময়েই সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। এরই মাঝে ১৯৬৮ সালে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শেখ হাসিনা। 

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিম জার্মানিতে পাঠ্যরত অবস্থায় থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা। ৭৫ পরবর্তী সময়ে দেশে নেমে আসে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। ক্ষমতালোভী তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী একথা খুব ভালোভাবেই জানত যে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসলে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাস্তবায়ন শুরু হবে এদেশে। তাই তারা নানাভাবে শেখ হাসিনার দেশে আসা ঠেকাতে তৎপর থাকে। 

১৯৮১ সালে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়অবশেষে ১৯৮২ সালে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তাঁকে বরণ করে নেয়ার জন্য লক্ষ মানুষের ঢল নামে বিমানবন্দরে। আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা শ্লোগানে উত্তাল করে তুলেন চারপাশ, শেখ হাসিনা ভয় নাই, আমরা তোমার লক্ষ ভাই দেশে ফিরেই জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার সংগ্রাম শুরু করেন শেখ হাসিনা। তিনি এবং তাঁর দল এরশাদ বিরোধী দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন এবং দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ১৯৯০ সালে অভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে স্বল্প ব্যবধানে পরাজিত হয় আওয়ামীলীগ এবং সংসদের প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী হন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের জাতীর নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামীলীগ এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন শেখ হাসিনা। শুরু হয় দেশের উন্নয়ন কাজ। বংগবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে সর্বশক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করেন শেখ হাসিনাবিচারের আওতায় আনা হয় বংগবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের যাদের পুনর্বাসিত করেছিল পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠী।

২০০১ সালের নীলনকশার নির্বাচনে পরাজিত হয় আওয়ামীলীগ। শেখ হাসিনা আবারও ফিরে যান বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভূমিকায়। তৎকালীন বিএনপি জামাত জোট সরকারের অপরিণামদর্শী কাজের ফলে দেশে আবারও ক্ষমতায় আসার সুযোগ পায় অনির্বাচিত সরকার। কারাবরণ করতে হয় শেখ হাসিনা সহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় সব নের্তৃবৃন্দকে। অবশেষে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। দ্বিতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন। দেশের উন্নয়নে শুরু হয় ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি যুদ্ধাপরাধীদের। ২০২১ সালের মাঝে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ ডিজিটাল সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। 

আজন্ম সংগ্রামী শেখ হাসিনাকে তাঁর জীবনের বাকে বাকে নানা বিপদ মোকাবেলা করতে হয়েছে। সর্বংসহা মত সবকিছু সহ্য করে দেশ গড়ার সংগ্রামে অবিচল আছেন তিনি। তাঁর দলের নেতাকর্মীরাও উনাকে ভালোবেসেছেন নিজের জীবনের চেয়েও বেশি। ১৯৮৭ সালে ২৪শে জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত জনসভায় তাঁর উপর হামলা চালায় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া বাহিনী। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বৃষ্টির মত গুলি ছোড়া হতে থাকে মঞ্চের দিকে। আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা মানবদেয়াল রচনা করে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে রক্ষা করেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে। একই ভাবে ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ২৩,বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামীলীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে মৌলবাদী অপশক্তি। সেসময়ও মানবদেয়াল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন দলীয় নেতাকর্মীরা। ভাবতেও অবাক লাগে, মানুষের মনের মনিকোঠায় কত উচ্চ আসনে অসীন হলে কেউ তাঁদের নেত্রীর জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে। শেখ হাসিনার অবস্থান আওয়ামীলীগের প্রতিটি নেতা কর্মী ও সমর্থকের আবগের সর্বোচ্চ শিখরে। 

দেশের গন্ডি পেরিয়ে শেখ হাসিনার অবদান আজ বিশ্বদরবারেও স্বীকৃত। শেখ হাসিনা বর্তমানে বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী নারী নেতাদের তালিকায় ৭ম স্থানে রয়েছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে অবদান রাখায় উনি দেশে বিদেশে সম্মানিত হয়েছেন নানা পুরষ্কারে। ৩০ ডিসেম্বর,২০১১ সালে শেখ হাসিনাকে বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক হিসেবে বাংলা একাডেমি তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। এছাড়াও,১২ জানুয়ারি,২০১২ইং তারিখে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি এবং উন্নয়নে অনন্য অবদানের জন্য ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডক্টর অব লিটারেচার বা ডি-লিট ডিগ্রী প্রদান করে। জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনেও উনি সম্মান সূচক সাউথ সাউথ পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। 

দুই সন্তানের জননী শেখ হাসিনা,পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। শেখ হাসিনা অনেকগুলো বইও রচনা করেন। তার লেখা বইয়ের মধ্যে ওরা টোকাই কেন ,বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম,দারিদ্র বিমোচন ও কিছু ভাবনা,আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি,বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন,সামরিক তন্ত্র বনাম গণতন্ত্র,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ,বিপন্ন গণতন্ত্র,লাঞ্ছিত মানবতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

একমাত্র শেখ হাসিনার নেতৃত্বই পারে বাংলাদেশকে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছে দিতে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করি যেন উনি জাতির পিতার সকল অসমাপ্ত কাজ শেষ করে যেতে পারেন।

আসুন 'ম্যানেজ কমিটি'র গল্প শুনি

নাহ, এভাবে চলতে পারে না। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। নিজের মনে মনে এই কথা গুলোই বলছেন রহিম মিয়া। রাগে নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে তার। আজ বিকালের মাঝে ঢাকায় তিন ট্রাক মাছ পাঠানোর কথা। ভাড়া করা ট্রাক বাড়ির সামনে চলেও এসেছে। ফিশারীর পুকুরে মাছও আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। তিলে তিলে পরিশ্রম করে এই ফিশারী গড়ে তুলেছেন তিনি। নিজের সঞ্চয়ের প্রায় পুরোটাই বিনিয়োগ করেছেন এতে। নিয়মিত যত্ন নেয়ায় মাছের উৎপাদনও হয়েছে খুব ভালো। কিন্তু মাছ ধরার জন্য পুকুরে জাল ফেলতে গিয়েই পড়লেন বিপত্তিতে, যে বিপদ তাকে তাড়া করে ফিরছে অনেকদিন ধরে। কিন্তু কেন? এর উত্তর পেতে হলে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যেতে হবে বেশ কয়েকবছর আগে।

বাবার মৃত্যুর পর ভাগ বাটোয়ারা করে আলাদা হয়ে যায় দুই ভাই- রহিম মিয়া ও করিম মিয়া। সৎ বড় ভাই করিম মিয়া অনেক বঞ্চিত করে রহিম মিয়াকে। ভাল ভাল জমি সব নিজেই নিয়ে নেয়। রহিম মিয়ার কপালে তেমন কিছুই জোটেনা। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন রহিম মিয়া। কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করেন তিনি। আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে তার। নিজের ঘোর বিপদের দিনে আশেপাশের তেমন কেউই খোজ খবর নেয়নি। কিন্তু যখনই একটু উন্নতির মুখ দেখলেন তখন থেকেই শুরু হল ঝামেলা।

প্রথম ঝামেলা দেখা দেয় যেদিন রহিম মিয়া নিজের পাওয়ার টীলারটি নিয়ে ক্ষেতে প্রথমবারের মত চাষ করতে যান সেদিন। ততদিনে তার অবস্থার বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বেশ কিছু জমি জমাও কিনেছেন। লাঙল দিয়ে চাষ করতে অনেক সময় লাগে বিধায় ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে উনি একটা পাওয়ার টীলার কিনেন। ঋণের টাকা শোধ করতে হবে এই চিন্তা থেকে আশেপাশের কিছু জমিও বর্গা নিয়েছেন। এক সুন্দর সকালে উনি পাওয়ার টীলারটি নিয়ে গেলেন ক্ষেতে চাষ করতে। গিয়ে দেখেন তার আগেই ক্ষেতে এসে হাজির গ্রামের গোটা দশ লোক। সাথে স্কুলের মাস্টার সাবও আছেন। রহিম মিয়া হাজির হতেই মাস্টার সাব জানালেন তারা গ্রামের ‘পরিবেশ’ কমিটির লোক। পাওয়ার টীলার দিয়ে জমি চাষ করলে গ্রামের পরিবেশ নস্ট হবে। পাওয়ার টীলার এর শব্দে শব্দদূষন হবে। অতএব পাওয়ার টীলার দিয়ে চাষ করা যাবে না, আগেরমত লাঙল দিয়েই করতে হবে। রহিম মিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। অনেক করে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পরিবেশ কমিটি কিছুতেই বুঝে না। উপরন্তু তারা গ্রাম্য সালিশের ভয় দেখাল। অবশেষে মাস্টার সাব কে আড়ালে ডেকে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললেন রহিম মিয়া। কিছুক্ষণ কথা বলেই ‘ম্যানেজ’ করে ফেললেন উনাকে। সেচের জন্য পাম্প দিয়ে পানি তোলার সময় এবং ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের সময়ও একইভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়েছে পরিবেশ কমিটিকে।

ভবিষ্যতের কথা ভেবে বেশ কয়েক বছর আগে বাড়ির চারপাশের অনেকগুলো মেহগনি গাছের চারা লাগিয়েছিলেন রহিম মিয়া। বাড়ি পাকা করার সময় তার কাঠের দরকার হল। উনি গেলেন তার গাছ কাটতে। আবারও সেই গোটা দশ লোক এসে হাজির। মাস্টার সাবও আছেন। এবার উনি জানালেন তারা ‘গাছরক্ষা’ কমিটির লোক। এভাবে তো গ্রামের গাছ কেটে ফেলা ঠিক না। পরিবেশ নস্ট হবে যে। রহিম মিয়া অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলেন। এটাও বললেন যে যতগুলো গাছ কাটবেন তার দশগুণ লাগাবেন। কিন্তু না। ‘গাছরক্ষা’ কমিটির লোক এসব বুঝতে রাজিনা। তাই মাস্টার সাবকে আড়ালে ডেকে নিয়ে আবারও ‘ম্যানেজ’ করতে হল ‘গাছরক্ষা’ কমিটিকে।

ফিশারী করার শুরুতেও একই ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল রহিম মিয়াকে। ফিশারী ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় রহিম মিয়া ঠিক করলেন মাছের চাষ করবেন। সড়কের ধারে তার তিন বিঘার একটা জমিও আছে। ফিশারীর জন্য চমৎকার জায়গা। যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে মাছ চাষের উপর প্রশিক্ষন নিলেন তিনি। এককালীন কিছু ঋণও নিলেন। কিন্তু পুকুর কাটতে গিয়েই পড়লেন বিপত্তিতে। আবারও সেই গোটা দশ লোক। এবার তারা এসেছে ‘ফসলি জমিরক্ষা’ কমিটির নামে। মাস্টার সাব বললেন ফসলি জমি নস্ট করে মাছ চাষ করা যাবে না। পরিবেশ নস্ট হবে। রহিম মিয়া অযথাই বুঝানোর চেষ্টা করলেন। এটাও বললেন যে ফিশারী করলে গ্রামের অনেকের কাজের সুযোগ হবে। কিন্তু পন্ডশ্রম। তাই ‘ফসলি জমিরক্ষা’ কমিটিকেও ‘ম্যানেজ’ করতে হল। 

সেই ফিশারীর মাছ তোলার জন্য আজ যখন জাল ফেলতে যাবেন তখন আবারও এসে হাজির ওই গোটা দশ লোক। এবার তাদের কমিটির নাম ‘মাছরক্ষা’ কমিটি। একসাথে এত মাছ তারা কিছুতেই ধরতে দিবেন না। এতে নাকি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। আর এবার যেহেতু অনেক বড় প্রকল্প তাই তারা ‘ম্যানেজ’ও হলেন না অল্পতে।

রহিম মিয়া ঠিক করলেন এভাবে আর না। গ্রামের মানুষ এখন শিক্ষিত ও সচেতন হয়েছে। উনি সবাইকে খোলে বললেন সব কথা। মুখোশ উন্মোচিত হল ‘ম্যানেজ’ কমিটির। শেষ পর্যন্ত শান্তিতে মাছ ধরার জাল ফেলতে পারলেন তিনি। ধীরে ধীরে উন্নতিও করলেন অনেক। অতঃপর রহিম মিয়া সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন।

পাদটীকাঃ সে এক দেশ ছিল ভাই, সে এক দেশ ছিল। ষোল কোটি মানুষের সেই দেশে শ’খানেক লোক ছিল। দেশের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বন্দর, বিদ্যুৎ, পাহাড়, পর্বত, বনভূমি, পরিবেশ সবকিছু রক্ষার দায়িত্ব তারা নিজেরাই কাঁধে তোলে নিয়েছিল। এর জন্য তারা একটি কমিটিও বানিয়েছিল। সেই কমিটি আবার কথায় কথায় আন্দোলন, অনশন, লং মার্চ, শর্ট এপ্রিল এসবও করত। সে এক দেশ ছিল ভাই!

মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

বিএনপি-রঙ্গঃ রিলোডেড

কোন কারণে আমার মন খারাপ হলে আমি অনলাইন নিউজসাইটে ঢুকে খোজে খোজে বিএনপি সংক্রান্ত খবরগুলো পড়ি। বিএনপির নেতারা এত্তো মজার মজার কথা বলেন এবং কাজ করেন যে তা দেখলে অল্পসময়েই আমার মন ভালো হয়ে যায়। সস্তায় বিনোদন পাওয়ার জন্য বিএনপির কোন বিকল্প নেই।
এই যেমন আজ বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর বললেন আওয়ামীলীগ নাকি মুক্তিযুদ্ধের দল নয়। তা মীর্জা সাহেব, আওয়ামীলীগের ব্যাপারে কথা বলবেন ঠিক আছে, কিন্তু নিজের পিতৃ পরিচয়টা মনে আছে তো ? আপনার পিতা মীর্জা রহুল আমিন ওরফে চখা মিয়া যে ঠাকুরগাও এর শীর্ষ স্থানীয় রাজাকার ছিলেন, তা মনে আছে ? নাকি ফরেন মালের সাথে সেটাও গিলে খেয়েছেন? রাজাকারের ছেলে দেয় মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট, এর থেকে মজার আর কি হতে পারে বলুন? 
আজকের জন্য এতটুকু মজাতেই আমার চলত। কিন্তু বিএনপি বলে কথা! আগেই বলেছি বিনোদন দিতে তাদের কোন জুড়ি নেই। তাই ফ্রী হিসেবে আজ তারা আরও একটি বিনোদন আইটেম পরিবেশন করল।
জাতীয় কাউন্সিল করার জন্য আবারও নির্বাচন কমিশনের কাছে সময় চেয়েছে বিএনপি। নির্ধারিত সময়ের মাঝে কাউন্সিল করতে না পারার কারণ হিসেবে তারা বলেছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কাউন্সিল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করা যায়নি। এজন্য ২০১৪ সালের ৩১ মে’ পর্যন্ত সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে তারা। বেচারারা আর কারণ খোজে পেল না। কাগজ নস্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাত দেখাতে হল। আমাদের বিনোদন দেয়া ছাড়া এর পিছনে আর কি ই বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে। উল্লেখ্য নিজেদেরকে এদেশের গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক দাবি করলেও বিএনপি দলের ভিতরে গণতন্ত্রের ছিটেফোটাও নেই। তাদের সর্বশেষ কাউন্সিল হয়েছিল ২০০৯ সালের ৮ই ডিসেম্বর। এরপর আর কাউন্সিলের আর কোন খোজ নেই। 
এই দুইটা খবর পড়েই নিউজ সাইট থেকে বের হয়ে গেলাম। একদিনে এর বেশি বিনোদন নেয়া আমার পক্ষে পসিবল না, বদহজম হতে পারে। শেষ একটাই কথা, বেঁচে থাকো বিএনপি-আমাদের নির্মল বিনোদনের উৎস হিসেবে। আহ বিএনপি, বাহ বিএনপি।

রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

আমার বন্ধু রাশেদ


জাফর ইকবাল স্যারের কিশোর উপন্যাস "আমার বন্ধু রাশেদ" অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রটি দেখলাম। দুই ঘন্টার জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম একাত্তর এর উত্তাল দিনগুলিতে। কখনো রাশেদ আবার কখনো বা ইবুর চরিত্রে। রাশেদের প্রতিটি পরিকল্পনা সফল হওয়ার সাথে সাথে নিজেই যেন সফল হলাম। শেষ দৃশ্যে রাজাকার আজরফ আলীর ছোড়া গুলি যেন রাশেদের বুক বিদীর্ণ করার সাথে সাথে আমার বুকটাও বিদীর্ণ করল। 


জাফর ইকবাল স্যার একবার বলেছিলেন, "একজন বিখ্যাত মানুষ দিয়ে কি হয়? কিছুই হয় না। কিন্তু একশো জন খাটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টিয়ে দেয়া যায়।" আসলেই তাই। এদেশে বিখ্যাত মানুষের খুব বেশি দরকার নেই। আমাদের দরকার বেশ কয়েক জন রাশেদকে। যারা তাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে দেশের জন্য কাজ করে যাবে, কি পেল না পেল তা নিয়ে ভাববে না। যারা প্রতিমুহূর্তে গাইবে, "জন্ম আমার ধন্য হল মাগো, এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাক।" তাহলেই এদেশটা খাটি সোনার বাংলা হবে।
 

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশ কিছু ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই চলচ্চিত্রগুলো গণমানুষের কাছে খুব ভালোভাবে পৌছানো যায়নি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশ কিছু ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র যেমনঃ ওরা এগারজন, আবার তোরা মানুষ হ, কলমীলতা, জয় বাংলা, অগ্নিসাক্ষী, ধীরে বহে মেঘনা, আলোর মিছিল, হাঙর নদী গ্রেনেড, নদীর নাম মধুমতি, মেঘের অনেক রঙ ইত্যাদির প্রিন্টও খুজে পাওয়া দুস্কর। সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি আগুনের পরশমণি, জয়যাত্রা, শ্যামলছায়া, গেরিলা প্রভৃতি চলচ্চিত্রগুলো শহর এলাকায় বেশ ভালো দর্শকপ্রিয়তা পেলেও গ্রামাঞ্চলে সেভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায়নি। অথচ এই সিনেমাগুলো সর্বস্তরে দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারলে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগরূক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। "আমার বন্ধু রাশেদ" সিনেমাটি দেশের সব স্কুলে দেখানোর ব্যবস্থা করা উচিত। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে এই সিনেমাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
 
 

মিঠামইন থেকে বঙ্গভবন

২০১১ সালের মার্চ মাস। কিশোরগঞ্জ জেলার এক বিচ্ছিন্ন উপজেলা মিঠামইনে এসে স্পিডবোট থেকে নামলেন তিনি। বোট থেকে নামার পর একটি রিকশা আনা হলো তাঁর জন্য। কিন্তু রিকশায় না উঠে অবলীলায় হাঁটতে শুরু করলেন সামনের দিকে। হেসে আমাদের উদ্দেশে বললেন, 'এ উপজেলায় কোনো গাড়ি তো নেই-ই, রিকশা-মোটরসাইকেলও হাতেগোনা। এখানে পায়ে হাঁটাই আমাদের অভ্যাস। আপনাদের হাঁটতে একটু কষ্ট হবে।' রোদের মধ্যেই সামনের দিকে হেঁটে চলছেন আর কুশল বিনিময় করছেন এলাকার মানুষের সঙ্গে। এরপর টানা প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে উপজেলা অতিথিশালায় ওঠা।

আর এই মানুষটিই বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ। ২০১১ সালের মার্চে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় এ সফরের সময় তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকার। কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন এবং অষ্টগ্রাম নিয়ে ছিল তাঁর নির্বাচনী এলাকা। যেখানে থেকে সাত সাতবার মানুষ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি করে জাতীয় সংসদে পাঠিয়েছেন তাঁকে। শুধু কি তা-ই! টানা দুই যুগেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। একই সঙ্গে জেলা বারের সভাপতি। স্পিকার হওয়ার সময় এ পদগুলো তাঁকে ছাড়তে হলেও এখনো তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে এসব সংগঠনে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না।

রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এখন তো আর তাঁর কোনো এলাকা নেই। সারা বাংলাদেশই তাঁর এলাকা। তবু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর বঙ্গভবনে ঢোকার আগে প্রথম তিনি ছুটে গেছেন সেই এলাকায়—যেখানকার মাটি-আলো-বাতাস তাঁকে ধীরে ধীরে পরিণত করে তুলেছে আজকের আবদুল হামিদ-এ। গত মে মাসে যখন তিনি তাঁর উপজেলা মিঠামইনে নামেন তখন তাঁকে নিতে রিকশার বদলে আসে কাপড়ে মোড়ানো ভ্যানগাড়ি। কিন্তু হাঁটতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন আবদুল হামিদ। নিরাপত্তা রক্ষীদের (এসএসএফ) অনুরোধে শেষমেশ ভ্যানগাড়িতে উঠলেন রাষ্ট্রপতি। ভ্যানে চড়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার এ ছবি আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম হয়ে উঠেছিল।

'তুইতো আমার দাদা' : ঘটনাটি ১৯৬৯ সালের শেষ দিকের। পাকিস্তানিদের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে তখন বাঙালি জাতি। নির্বাচনের মাধ্যমে গণরায় নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। প্রার্থী ঠিক করা হচ্ছে, জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের জন্য। এসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডেকে পাঠালেন কিশোরগঞ্জের তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হামিদকে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ডেকে তাঁকে বললেন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু আবদুল হামিদের দাবি জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের টিকিট পাওয়া। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমিতো জর্জ সাহেবকে কথা দিয়ে ফেলেছি। তুই এবার প্রাদেশিক পরিষদে জিতে আয়। পরে দেখবো নে।' জর্জ সাহেব মানে সাবেক এক জজকে তিনি ওই এলাকায় জাতীয় পরিষদের নির্বাচন করার জন্য কথা দিয়েছেন।

কি আর করা, বঙ্গবন্ধুর কথা মানে তো নির্দেশ। এলাকায় ফিরে গেলেন হামিদ প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের টিকিট নিয়ে। এর অল্প কয়েকদিন পরেই আবার বঙ্গবন্ধু কিশোরগঞ্জ থেকে জরুরি তলব করলেন আবদুল হামিদকে। হামিদ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাসায় এসে দেখেন বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে লনে হাঁটছেন। আবদুল হামিদকে একনজর দেখার পরে তিনি জোরে হেসে উঠলেন। রাষ্ট্রপতি হামিদের ভাষায়, 'বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে প্রায় এক মিনিট জোরে হাসছিলেন। আর আমি ভয়ে জামা-প্যান্ট ঠিক আছে কিনা সেদিকে খেয়াল করছিলাম। কিন্তু হাসির কারণ বুঝতে পারিনি। হাসি থামিয়ে এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, তুইতো আমার দাদারে। তোকে আমি জোর করে জাতীয় পারিষদে না দিয়ে প্রাদেশিক পরিষদে দিলাম। আর জাতীয় পরিষদে যাকে দিলাম, সেই জাজ সাহেবতো মারা গেলেন। এখনতো তোর প্রস্তাবমতোই জাতীয় পরিষদে তোকে প্রার্থী করতে হবে।' এরপর নির্বাচন হলো। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়ে এলেন আবদুল হামিদ।

এক ঘরোয়া আড্ডায় ওই সময়ের স্পিকার, বর্তমান রাষ্ট্রপতির গল্পটা এখানেই শেষ হয়নি। মজা করে তিনি বলছিলেন, 'এ ঘটনা নিয়ে পরে একবার আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। কারণ এ বিষয়টি যে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জানেন সেটা আমার জানা ছিল না।'

রাষ্ট্রপতির ভাষায়, '১৯৭০-এর পর চলে গেছে অনেক দিন, অনেক বছর এবং কয়েক যুগ। ১৯৯৬ সালে ৫ম বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ওই সময়ের সরকারি দল আওয়ামী লীগ আমাকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করে। স্পিকার নির্বাচিত করা হয় সাবেক মন্ত্রী হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে। ২০০১ সালের ১০ আগস্ট স্পিকার থাকাকালেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এরপর ৭ম জাতীয় সংসদের বাকি সময়টা স্পিকারের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এরপর ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদে বিরোধী দলে যায়। বিরোধী দলীয় নেত্রী হন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধী দলীয় উপ নেতা কাকে করা হবে—এ আলোচনায় এ পর্যায়ে আমাকে ডেকে পাঠান তিনি। হেসে ওই সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, হামিদ সাহেব, আপনাকে বিরোধী দলের উপনেতা করলে তো আমি ঝুঁকিতে পড়ে যাই। কারণ আপনার ওপর কাউকে দিলে তো সে শেষ পর্যন্ত বাঁচে না। কিন্তু বিরোধী দলের উপনেতা তো আপনাকেই করতে চাই। এখন কী হবে। প্রধানমন্ত্রী এবার উদাহরণ দিয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচনের প্রার্থী এবং মরহুম স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর নাম বললেন। বিব্রতকর পরিস্থিতি সামলে কোনো মতে জবাব দিলাম—কাকতালীয়ভাবে দুটি ঘটনা ঘটলেও এবার আর ঘটবে না। কারণ আপনি না থাকলে তো আমিও নেই।'
সংসদ রিপোর্টিং করার কারণে তাঁর সঙ্গে মেশার সুযোগে এ ধরনের অসংখ্য কাহিনি শুনেছি। বাস্তবে দেখেছি বেশ কিছু ঘটনা। এর একটি ঘটনা সম্ভবত ২০০৬ সালে। তিনি তখন বিরোধী দলীয় উপনেতা। তাঁর এক স্নেহভাজন সাংবাদিকের মায়ের মৃত্যুর পর আয়োজিত এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি গাজীপুরে যাবেন। কিন্তু মন্ত্রী পদমর্যাদাসম্পন্ন বিরোধী দলীয় নেতাকে যে গাড়ি সরকার থেকে দেওয়া হয়েছিল তা নষ্ট থাকত বেশিরভাগ সময়ই। ওই সংসদের মেয়াদে অনেকবার বলেও একটি ভালো গাড়ি সরকারের কাছ থেকে জোগাড় করা যায়নি। ওই ভাঙা গাড়ি নিয়েই কষ্ট করে চলতে হয়েছে তাঁকে।

আর তাই একজন তরুণ সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে ওই ভাঙা গাড়ি সম্বল করেই ছুটলেন তিনি গাজীপুরে। পথিমধ্যে যা হবার তা-ই। নষ্ট হয়ে গেল গাড়ি। ড্রাইভার অনেক চেষ্টায়ও তা ঠিক করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় একজন নেতাকে ডেকে অন্য গাড়ি করে গাজীপুরে পৌঁছেন তিনি। তিনিই আবদুল হামিদ। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি।

স্পিকার হিসেবে আবদুল হামিদ হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন ধরনের মজা করে সংসদকে প্রাণবন্ত করে তুলতে তাঁর জুড়ি আর হবে কিনা বলা মুশকিল। অনেক কঠিন কথা মজা করে বলার এক অদ্ভুত গুণ রয়েছে তাঁর। সবসময় বিরোধী দল স্পিকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে সংসদ বর্জনের নজির থাকলেও তাঁর সময় খুব একটা তা হয়নি। বরং তাঁর প্রতি স্বয়ং বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার এক ধরনের আস্থা রয়েছে। আর এ কারণেই সম্ভবত সবকিছু নিয়ে বিভক্তির এ দেশে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে নিয়ে বিরোধী দল প্রতিবাদ করেনি। বরং তাঁকে গ্রহণ করেছে অনেকটা ইতিবাচকভাবে। রাজনৈতিক বিভক্তির এ দুঃসময়ে এটিও একটি বড় ঘটনা।

ডিমের মামলেট এবং : রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস অনেক রাত করে ঘুমুতে যাবার। এর অবশ্য একটি বড় কারণ তাঁর রাজনীতি। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ফিরে এসেছে—এমন অভিযোগ সম্ভবত তাঁর শত্রুও করতে পারবে না। রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত তিনি কথা বলেন হয় সংসদ সদস্য, নইলে সাংবাদিক কিংবা এলাকার কোনো লোকের সঙ্গে। দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাসের সঙ্গে দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাসও রয়েছে তাঁর। ফলে সকাল দশটায় কোনো অনুষ্ঠানে যেতে হলে আগে ভাগেই প্রস্তুতি নিতে হয়। আর ভোর বেলায় শহীদ মিনার বা জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাবার আগের রাতে না ঘুমানোই হলো তাঁর কৌশল।

ঘুম থেকে উঠে ডিমের মামলেট আর রুটি দিয়ে নাস্তা সারেন তিনি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সংসদ ভবনের বাসায় পৌঁছে যায় বঙ্গভবনের নিরাপত্তাবাহিনী, ডাক্তারসহ সব কর্মকর্তা। এখন রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর হাতে করা ডিম ভাজিও তাঁর কাছে আসে না নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সামরিক বাহিনীর ডাক্তারের পরীক্ষা ছাড়া। বাসায় করা ডিম ভাজির এক অংশ ডাক্তার খেয়ে পরীক্ষা করার পর রাষ্ট্রপতির খাওয়ার নিয়ম। এ নিয়ম দেখে মজার মানুষ আবদুল হামিদ এসএসএফের ডাক্তারকে হেসে বললেন, 'আরে ভাই, একটি ডিমের মামলেটের দুই চামচ যদি পরীক্ষা করতেই শেষ হয়, তাহলে আমি খাব কী? আর যে ভদ্রমহিলা ৪৫ বছরে আমাকে খাবারে বিষ দিয়ে মারেনি, সে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এখন কেন মারবে?'

সংসদ ভবন ছাড়তে কষ্ট : রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জীবনের বড় অংশটি কাটিয়েছেন জাতীয় সংসদ ভবনে। সাত বারের সংসদ সদস্য, দুই বার স্পিকার, একবার বিরোধী দলের উপনেতা, একবার ডেপুটি স্পিকার—কার্যত তাঁর জীবনটাই কেটেছে সংসদকে ঘিরেই। ১৯৭০ থেকেই তো তিনি সংসদে।

তাই রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বঙ্গভবন তাঁকে খুব একটা টানেনি। সংসদ ভবনের স্পিকারের বাসা ছেড়ে বঙ্গভবনে উঠতে তাই সময় লেগেছে প্রায় তিন মাস। স্বাধীনতা পদক পাওয়া ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম ঘোষণার পর সংসদ এবং সংসদ সচিবালয় থেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধিত করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি। এক পর্যায়ে রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছে তিনি বলেন, 'আমি জানি আমার জীবনে হয়তো আর সংসদ ভবনে ওইভাবে আসতে পারব না। কিন্তু এ সংসদ ভবন, সংসদ চত্বর আমাকে সবচেয়ে কাছে টানে। জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় তো কাটিয়ে দিলাম এখানেই। তাই সংসদ ভবন এলাকা ছাড়তে হবে ভাবতেই বিষাদে মনটা ভরে যায়। তবে রাষ্ট্রপতি হলে অধিবেশন চলাকালে ঘন ঘন এখানে আসব। বসে বসে দেখব সংসদ অধিবেশনের কার্যক্রম।'

সত্যি গত বাজেট অধিবেশনে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট পেশের সময় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংসদে এসেছিলেন। সংসদে সাংবাদিক লাউঞ্জে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা মারতে একবারের জন্যও ভোলেননি তিনি। রাষ্ট্রপতির বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর (এসএসএফ) সদস্যরা হতচকিত হয়ে যান রাষ্ট্রপতির সাংবাদিক গ্যালারিতে বসে এ আড্ডা মারা দেখে। সম্ভবত তিনিই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি সাংবাদিক লাউঞ্জে ঢুকে সাংবাদিকদের খোঁজ নিলেন। ব্যক্তিগত পর্যায়েও খোঁজ-খবর নিলেন অনেকের। সাংবাদিকদের বঙ্গভবনে দাওয়াত দিতেও ভোলেননি তিনি।

এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারানো সাংবাদিক নিখিল ভদ্রের খোঁজ নিতেও ভোলেননি আবদুল হামিদ। নিখিল ভদ্র এখন কৃত্রিম পা লাগিয়ে পেশায় ফিরে এসেছেন। সংসদ কাভার করছেন আগের মতোই। নিখিলের দুর্ঘটনার পর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন তিনি। এমনকি অনেক সময় আবদুল হামিদের ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়েও নিখিলকে সংসদে আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আবদুল হামিদ।

আবদুল হামিদের স্বপ্ন : রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের একটা স্বপ্ন আছে। তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকার তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন এবং অষ্টগ্রাম থেকেই বাসে করে ঢাকায় আসতে চান। সেখানে বাসের হেলপাররা যাত্রীদের দৃষ্টি কাড়তে চিত্কার করে ডাকবেন—'ডাইরেক্ট ঢাকা, ডাইরেক্ট ঢাকা।' মৃত্যুর আগে আর কিছু চাওয়ার নেই তাঁর। তাঁর স্বপ্নের এ কথাটি তিনি অবশ্য বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে স্পিকার থাকা অবস্থায়।

কিশোরগঞ্জের অবহেলিত হাওর এলাকা থেকে ১৯৭০ সাল থেকে টানা নির্বাচিত সাংসদ আবদুল হামিদ এভাবেই 'ইত্তেফাক'কে বলেন তাঁর স্বপ্নের কথা। বিস্তীর্ণ ওই এলাকা সরেজিমন ঘুরে বোঝা গেছে যে, আসলে ওটা স্বপ্নই। ওই তিন উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-৪ নির্বাচনী এলাকার মিঠামইনে স্পিকারের বাড়ি। ওই উপজেলায় শুকনা মৌসুমে চলাচলের জন্য কোনো যানবাহন নেই। ট্রলার, স্পিডবোড কিংবা নৌকায় করে উপজেলার ঘাটে নামার পর হেঁটেই চলতে হয়। হাওর এলাকার অন্য উপজেলাগুলোতেও গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে।

কিশোরগঞ্জ শহর থেকে বাসে এক ঘণ্টা লাগে চামড়াঘাট যেতে। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় প্রায় তিন ঘণ্টার পথ মিঠামইন। শস্য আর মাছের ভান্ডার হিসেবে খ্যাত হাওর অঞ্চলের সবচেয়ে ছোট উপজেলা এটি। চারদিকে বাঁধ দিয়ে উপজেলা সদর তৈরি করা হয়েছে। বাঁধের পাশে সারি সারি নারিকেল গাছ। শুকনা মৌসুমে যতদূর চোখ যায় ফসলভরা মাঠ। ধান, আলু, বাদাম, কী হয় না এখানে। আর বর্ষাকালে এটি অথৈ সাগর। গ্রাম-জনপদগুলো যেন খেলনার মতো পানির মধ্যে ভাসতে থাকে। হাওরে তখন প্রচুর মাছ মেলে। বর্ষা শেষে ধান ফলে দেশের অন্য যেকোনো এলাকার চেয়ে বেশি।

সেই মাটি থেকেই উঠে এসেছেন আবদুল হামিদ। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে মিঠামইনের কামালপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া সেই শিশুটিই আজকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। কিন্তু গায়ে হাওরের সেই পানি-কাদা। হাওরের পলি মাটিতে বেড়ে ওঠা আবদুল হামিদের ঠিকানা এখন বঙ্গভবন।

-আশিস সৈকত
দৈনিক ইত্তেফাক

মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কাদের মোল্লার রায়ের প্রেক্ষিতে কিছু কথা




আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামের পঞ্চম শীর্ষ নেতা কাদের মোল্লা ওরফে কসাই কাদেরের বিচারের চূড়ান্ত রায় দিয়েছে। সকলের প্রত্যাশামাফিক এই রায় হয়েছে ফাঁসি। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে এ এক অনন্য মাইলফলক। এ অর্জন এদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রতিটি মানুষের অর্জন। এ অর্জন এদেশের লাখ তরুণের বজ্র নিনাদ কন্ঠে ধ্বনিত শ্লোগানের বিনিময়ে অর্জন। এ অর্জন রাজীব হায়দার, জাফর মুন্সী, জগতজ্যোতি তালুকদার, আরিফ রায়হান দীপ এর রক্তের দামে কেনা অর্জন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই অর্জন স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।

অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারকে। কারণ শত প্রতিকূলতার মাঝেও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে এই সরকারই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করেছে। ধন্যবাদ জানাতে চাই প্রজন্মের সকল যোদ্ধাদের যারা দীর্ঘ সময় ধরে এই রায় আদায়ের জন্য রাজপথে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলি। দুধের মাঝে কাটা খোজার মত অনেকেই জামাতের সাথে আওয়ামীলীগের আঁতাত খুজে বেড়িয়েছেন প্রতিনিয়ত। গোলাম আজমের রায়ের পর মুচকি হেসে বলেছেন, বলেছিলাম না আঁতাত হয়েছে। আমরা তখন চুপ থেকেছি, বিশ্বাস রেখেছি জননেত্রী শেখ হাসিনার উপর যার ধমনিতে হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ধাবমান, যে রক্ত কখনো বেইমানি করতে জানে না। কাদের মোল্লার আপিলের রায় দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন-তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। অথচ একটিবার খোজ নিয়ে দেখেননি কিভাবে চলছে বিচারের কার্যক্রম। বিচারটিকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে ট্রাইবুন্যাল রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের বক্তব্য নেয়ার পাশাপাশি সাতজন অ্যামিকাস কিউরির মন্তব্য নিয়েছেন। এর জন্যই কিছুটা সময় বেশি লেগেছে। অবশেষে আমরা পেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত চূড়ান্ত রায়, কাদের মোল্লার ফাঁসি। প্রমাণিত হল এদেশে ভিক্টরি সাইন শুধু স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষই দেখাবে, কোন রাজাকার নয়। এ রায় কবে কার্যকর হবে, আদৌ হবে কিনা এটা নিয়েও সংশয়বাদীরা নানা কথা বলছেন। এটা নিয়ে আমরা কিছুই বলব না। বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়। কিছুদিনের মাঝেই যখন ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে কসাই কাদেরর লাশ তখন আমরা মুচকি হাসব, আবারও ভিক্টরি সাইন দেখাব। সেই ভিক্টরি সাইনই হবে সংশয়বাদীদের গালে চরমতম চপেটাঘাত।

এবার আসুন মূদ্রার অপর পিঠটা খেয়াল করি। বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে এদেশে পুনর্বাসিত করেছে, তাদের সাথে জোট বেঁধেছে, তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছে-এসব পুরানো ইতিহাস। সবাই জানেন। সাম্প্রতিক সময়ের দিকে খেয়াল করুন। গতকাল ও গত পরশু আঠারদলীয় জোটের জনসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের রাজবন্দী উল্লেখ করে তাদের মুক্তি দাবি করেছেন। জনসভাগুলোয় খালেদা জিয়ার সাথে একই বেলুনে উড়েছে গোলাম আজম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান সহ অন্যান্য রাজাকারের ছবি। এমনকি আজকে কাদের মোল্লার রায়ের পর জামায়াতের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাজ্জাক যে সংবাদ সম্মেলন করেছে সেই সংবাদ সম্মেলনেও হাজির ছিলেন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ হোসেন ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বিএনপি যদি পুনরায় এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারে তাহলে এই যুদ্ধাপরাধীদের কি হবে।  তারা সবাই সসম্মানে জেল থেকে বেড়িয়ে এসে পুনরায় রাষ্ট্রীয় পদে অসীন হবে। তারপরও কি আপনারা এই ভুল করবেন?

ভাইরে, ৪২ বছরের ক্ষত এত অল্প সময়ে শুকাবার নয়। এই সংগ্রাম টেস্ট ম্যাচের মত, টি-টুয়েন্টির মেজাজ নিয়ে খেললে হবে না। যে আশা নিয়ে আপনারা ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগকে বিপুল ম্যান্ডেট দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছিলেন তা পূরণ করার জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার তার যথাসর্বস্ব করেছে। আবার আমরা আপনাদের কাছে এসেছি ভোটের জন্য। সামনের জাতীয় নির্বাচনে যদি আওয়ামীলীগকে পুনরায় নির্বাচিত করেন তাহলে আপনাদের সব প্রত্যাশা পূরণ হবে। সকল যুদ্ধাপরাধীদের সাজা কার্যকর হওয়ার পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়ন হবে। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। বিশ্বাস রাখুন জননেত্রী শেখ হাসিনার উপর, বিশ্বাস রাখুন আওয়ামীলীগের উপর। তাঁরা আপনাদের কখনোই হতাশ করবেন না। আর যদি এর অন্যথা হয় তাহলে আওয়ামীলীগ যতটা না ক্ষতিগ্রস্থ হবে তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি হবে এই দেশের, এদেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার। বাকিটা আপনাদের বিবেচনা।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ।।