রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৩

জাতীয় সংসদে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহারঃ উত্তাল অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম



নবম জাতীয় সংসদের চলতি আঠারতম অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন কারণে সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। প্রথমত, এই অধিবেশনের মাধ্যমেই দায়িত্ব পালন শুরু করছেন দেশের ইতিহাসের প্রথম মহিলা স্পীকার ডঃ শিরিন শারমিন চৌধুরী। নারী ক্ষমতায়নের ইতিহাসে এটা নিশ্চয়ই অনেক বড় মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন থেকে সংসদে অনুপস্থিত থাকা চারদলীয় জোটের সংসদ সদস্যদের এই অধিবেশনে যোগ দিতেই হত, অন্যথায় নব্বই কার্যাদিবসের অধিক সময় সংসদে অনুপস্থিত থাকায় তাদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যেত। তৃতীয়ত, এই অধিবেশনেই মহাজোট সরকার তাদের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট পেশ করবে। কিন্তু গত তেসরা জুন অধিবেশন শুরু হওয়ার পর এখন সবকিছু ছাড়িয়ে আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে সংসদে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার। এর প্রভাব পড়েছে অনলাইনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুক ও ব্লগসাইট গুলোতেও। অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রতিনিয়তই আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ফেসবুক ও ব্লগগুলোতে, রচিত হচ্ছে বিভিন্ন স্যাটায়ার, কৌতুক আর ক্যারিকেচার।
গত নয়ই জুন বিএনপি দলীয় সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু সরকারকে উদ্দেশ্য করে সংসদে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে চুদুরবুদুর চইলতো ন। তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে সর্বত্র। সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা সংসদেই এর প্রতিবাদ জানান এবং স্পীকারের কাছে এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জের দাবি জানান। সমালোচনা শুরু হয় ফেসবুকেও। অনেকেই এধরনের শব্দ চয়নের জন্য সাংসদ রেহানা আক্তার রানুর প্রতি বিশেদাগার করেন। চুদুরবুদুর শব্দটি অশ্লীল কিংবা অসংসদীয় কিনা তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। কলকাতার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাও এ নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট করে। অবশ্য রেহানার বলা এবারের শব্দটির মধ্যে অশ্লীল কিছু খুঁজে পায়নি আনন্দবাজার। সাংসদ রেহানা আখতারের বিষয়ে আনন্দবাজারের পর্যবেক্ষণ, তার মুখএমনিতেই বেশ লাগামছাড়া সরকারকে আক্রমণ করতে তিনি যে সব বাছা বাছা শব্দের তীর  ছোড়েন, তার একটা বড় অংশই পরে কার্যবিবরণী থেকে মুছে ফেলতে হয়। এব্যপারে জনপ্রিয় ফেসবুক ইউজার সবাক পাখি তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেন,
কৈশোরে এলাকার সব বয়সী মানুষকে একটা শব্দ খুব বেশি ব্যবহার করতে দেখতাম। শব্দটা হলো চ্যাঙ, মানে নুনুকোন কিছুতে বিরক্ত হলেই একটু টেনে বলতো চ্যাঙসুতরাং চ্যাং অশ্লীল না। এর অর্থ হচ্ছে আঁই বিরক্ত!
যাইহোক, এক চাচার চ্যাং বলার অভ্যাসটা খুব ভয়াবহ ছিলো। একদিন দেখলাম উনি খুব খ্যাপা। জিজ্ঞাসা করলাম কী হইলো চাচা? চাচায় কয়,
চ্যাঙেরে কইছি চ্যাঙ বাঁধতে, চ্যাঙে চ্যাঙের মত করি চ্যাঙ বাঁধছে, চ্যাঙ ছুঁডি যাই চ্যাঙ খায়ালাইছে।
তর্জমা : পোলারে কইছি গরু বাঁধতে, পোলা এমনভাবে গরু বাঁধছে, গরু বাঁধন ছিঁড়ে গিয়ে ধান খেয়ে ফেলছে।
ওরে খাইছে, এইবার দেখি চ্যাঙের ম্যালা অর্থ! আপনি কোনটা নিবেন?
এইবার আরেকবার মনে করিয়ে দিই চুদুরভুদুর এর কথা। নোয়াখালীতে এর আরেকটা রূপ আছে। চোদরভোদর। যা মূলত চোদা ভোদা শব্দ থেকে এসেছে। কিন্তু ব্যবহার করা হয়
গড়িমসি ধানাই পানাই এসব অর্থে। এর আরো কয়েকটি প্রতিশব্দের মধ্যে নয় চইদ্দ, নয় ছয় এবং হাংকি পাংকি অন্যতম। আরেকটা কথা। চুদুরবুদুর শব্দটি অশ্লীল কিনা এবং এটি সংসদে ব্যবহারের উপযোগী কিনা, এটা জানার জন্য কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ার দরকার নাই।
আরো একটা কথা। মতিকণ্ঠ যখন চুদুরবুদুর লেখে তখন নাউযুবিল্লাহ। রানু আপায় কইলে মাশআল্লাহ!
 
উল্লেখ্য, গত বছর রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়েও বিএনপির সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে কালনাগিনী, ডাইনি, প্রধান বিচারপতিকে পাগল ইত্যাদি অশালীন ভাষা ব্যবহার করে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমেরিকার সাদা চামড়ার এক বুড়ি শয়তান, ডাইনি, বান্দরনীকে এনে সাক্ষী বানানো হয়েছে। আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান চলে যেতে বলেছেন। কিন্তু মানুষ বলে, চশমাওয়ালা বুবুজান নৌকা নিয়ে ভারত যান। তিনি আরও বলেন, গানে বলে তু তু তু তুতুতারা, মর্জিনার মা মার্কা মারা। আর মানুষ বলে, তু তু তু তুতুতারা, শেখ হাসিনার মুখ মার্কা মারা। এছাড়াও, ২০১১ সালের ১৬ মার্চ বিএনপির সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েক মন্ত্রীকে কটূক্তি করে বক্তৃতা করেন। বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে আর কোনো কটূক্তি করা হলে জিভ কেটে ঝুলিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেন তিনি।
গত আঠারই জুন নতুন আলোচনার খোরাক জোগান বিএনপি দলীয় সংরক্ষিত আসনের আরেক সাংসদ শাম্মী আখতার। উনি সংসদে  তাঁর বক্তব্যে কবি হেলাল হাফিজের যার যেখানে সময় কবিতাটির একাংশ পাঠ করেন। কবিতার শেষ লাইন দুটি ছিল,
রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি,
আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি।
তাঁর এই বক্তব্যের পরপরই আবারো ঝড় উঠে ফেসবুক এবং ব্লগগুলোতেএধরনের বক্তব্য হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে সচেতন প্রতিটি  মানুষকেই। সংসদের মত পবিত্র স্থানে দাঁড়িয়ে এধরনের অশোভনীয় শব্দ ব্যবহারের কারণে শাম্মি আক্তারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন সবাই। ব্লগার অঙ্কনের সাতকাহন সামহোয়্যার ইন ব্লগ এ লিখেন
ছোটবেলায় যদি অতিরিক্ত কোন দুষ্টামি বা কোন বড় ধরনের অঘটন ঘটিয়ে ফেলতাম তখন ই আমার জান্নাত বাসী নানা আমাদের বলতেন সালারা চুদুর-বুদুর  কর । তাই চুদুর বুদুর কথাটাকে হালকা ভাবে ই নিয়েছিলাম । কিন্তু গত কাল যখন আবার বিরোধী দলীয় আরেক নারী সাংসদ শাম্মি আক্তার মহান সংসদে দড়িয়ে কবি হেলাল হাফিজ এর কবিতা যার যেখানে জায়গা এর শেষ পংক্তি  আমিও গ্রামের পোলা চুত্‌মারানি গাইল দিতে জানি  আউরালেন তখন কেন যানি আমার নিজের প্রতি নিজের ই ঘৃনা জন্মলো । হয়রে কপাল এ কোন দেশে আমি জন্মেছিলাম । একজন সাংসদের নূন্যতম সেই জ্ঞান টুকু নেই যে কবিতা টি আমি আউরাচ্ছি তার শিরোনাম টা কি ? তাই আমার প্রশ্ন আমরা জাতি হিসেবে কি ক্রমানয়ে ই কি মেধা শূন্য হয়ে যাচ্ছি ? এই যদি হয় একজন সাংসদের জ্ঞানের নমুনা তা হলে আমাদের জাতির জ্ঞানের নমুনা কি হবে ? সংসদের কার্যকরী প্রতিটি সভায় প্রতিটি মিনিটে কত টাকা খরচ হচ্ছে সে হিসেব বুঝি মাননীয় সাংসদ নিজেও রাখেন না। আর তাই সংসদের মূল্যবান সময়ে দেশের সব মাথাগুলো দুলেদুলে কবিতা শোনেন। জনগণের রক্ত-ঘাম ঝড়ানো পয়সার এরচে সর্বোত্তম ব্যবহার আর কি হতে পারে!
আরেক ফেসবুক ইউজার জিনিয়া জাহিদ লিখেন,
জাতীয় সংসদের এইসব অধিবেশনকে অবিলম্বে ১৮+ ঘোষিত করা উচিত। কারণ, অন্তত সুরুচিপূর্ণ জনগণ রেটিং দেখে তাদের সন্তানদের হিংসা, গালিগালাজ, নোংরামি, কুরুচির হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে সমর্থ হবে।
শাম্মী আক্তার নামটিই যেন অনলাইনে এখন গালিতে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক ইউজার শাম্মী হক তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেন,

ওরে আমারে কেউ বাঁচাও....
ফেবু তে ঢুকলেই সবার স্ট্যাটাসে শাম্মী শাম্মী কইয়া চিল্লা পাল্লা দেখতাছি,সাথে গালি তো আছেই।
এই প্রথম বারের মতো নিজের নাম নিয়া খুব আফসোস লাগতাছে।ইচ্ছা করতাসে নামটা পাল্টাই।
কোন উপায় আছে কি?

বিএনপি দলীয় আরেক মহিলা সাংসদ নীলুফার ইয়াসমিন মনি একুশে জুন সংসদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের প্যারোডী করে বক্তব্য দেন। এটা নিয়েও ব্যাপক সমালোচন হয় ফেসবুকে।  জনপ্রিয় ফেসবুক ইউজার মহামান্য কহেন লিখেন,
৭-ই মার্চের ভাষনের প্যারোডি করেছেন বিএনপির সাংসদ নিলোফার মনি চৌধুরী। তাও আবার খোদ সংসদে দাঁড়িয়ে। অথচ এ ভাষন স্বাধীনতার প্রথম আহবান। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মুক্তির প্রথম প্রহরের সনদ।
আজ যদি সে ভাষনের প্যারোডি করা যায়, তাহলে বুঝতে হবে তাদের কাছে এই রাষ্ট্রের কোন মূল্য নেই। স্বাধীনতার মূল্য নেই। অবশ্য যে জাতির কাছে নির্বাচন মানে উৎসব, রাজনৈতিক অধিকার সচেতনতা নয়। দেশের ভালো-মন্দ দেখভালের দায়িত্ব নয়। সে জাতির পুর্ব পাকিস্তান নামে ফিরে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আজকের সংসদ অধিবেশন এ দেশের জন্য একটা কালো দিন। পুর্ব পাকিস্তানের দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়ার চিহ্ন মাত্র। কিছু মানুষ প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। ৭১'এর ন্যায় তাদেরও বুটের নীচে আবারো চাপা পড়তে হবে।



উল্লেখ্য সাংসদ নীলুফার ইয়াসমিন মনি টকশো তেও একবার মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তখনও এটি নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
বিরোধী দল যোগ দেওয়ায় জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন যে প্রাণবন্ত হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অধিবেশনের প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং উৎসাহও বেড়েছে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশন প্রতিপক্ষহীন খেলার মাঠে একতরফা গোল করার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গোলের সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, খেলোয়াড়ের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণিত হয় না।সংসদে এখন ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্বভাবতই সবার প্রত্যাশা ছিল, সংসদে বাজেটের চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। বিরোধী দলের সাংসদেরা বাজেটের দুর্বলতা ও ত্রুটিগুলো তুলে ধরবেন, জবাবে সরকারি দলের সাংসদেরা তাঁদের যুক্তি খণ্ডনে সচেষ্ট থাকবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাজেট আলোচনায় এ নিয়েই কথাবার্তা কম। উভয় দলের সাংসদেরা বাজেট বক্তৃতার সুযোগে নিজ নিজ দলের মহিমা প্রচার করছেন এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করছেন। কোনো কোনো সাংসদ সংসদীয় রীতিনীতি না মেনে অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করতেও দ্বিধা করছেন না। সাংসদেরা ভুলে যান, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং পরস্পরকে গালাগাল করে তাঁরা যে সময় নষ্ট করছেন, তার পুরো ব্যয় বহন করা হয় জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে। জনগণ তাঁদের সংসদে পাঠিয়েছেন আইন প্রণয়নের জন্য, জনগণের অভাব-অভিযোগ ও দুঃখ-কষ্টের কথা বলতে। কিন্তু সাংসদেরা দলীয় স্বার্থে এতটাই অন্ধ যে তাঁদের ওপর অর্পিত সেই দায়িত্ব তাঁরা বেমালুম ভুলে যান।


Top of Form
Bottom of Form





  

মাইডাস টাচ হাতে পাওয়া এক রাজপুত্তুরের গল্প


প্রথমেই আসুন মাইডাস টাচের গল্পটা শুনে আসি। গ্রীক পুরাণে বর্ণীত আছে প্রাচীন ফ্রিজিয়াতে (বর্তমানে তুরস্ক) একসময়ের রাজা ছিলেন মাইডাস। তার বাবার নাম ছিল গরডিয়াস। একদম হতদরিদ্র অবস্থায় বাবার হাত ধরে ফ্রিজিয়াতে প্রবেশ করে মাইডাস। কাকতালীয় ভাবে যেদিন ওরা এল, সেদিনই নাকি রাজ্যের পরবর্তী রাজা ষাঁড়ের টানা ওয়াগনে চেপে রাজধানীতে প্রবেশ করবেন বলে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন এক ওরাকল (জ্যোতিষী)। মাইডাসের বাবাকে তৎক্ষণাৎ রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় লোকজন। বাবার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহন করেন মাইডাস। রাজ্যের অঢেল ধনদৌলতেও মন ভরছিল না মাইডাসের। দেবতাদের কাছে আরও ধন সম্পদের জন্য প্রার্থনা করেন মাইডাস। তার প্রার্থনা আর নৈবদ্যের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা তাকে এক অদ্ভুত বর দেন-শুধু স্পর্শ করেই যেকোন বস্তুকে সোনায় রুপান্তর করতে পারবেন তিনি। এটাই মাইডাস টাচ নামে পরিচিত। 

কল্পকাহিনী থেকে বাস্তবের জগতে আসা যাক। আমাদের এই দুখী বাংলাতেও মাইডাস টাচ হাতে এক রাজপুত্তুরের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য(!) হয়েছে আমাদের। যিনি কোন স্বীকৃত ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। যার অর্থ উপার্জনের গল্প পৌরাণিক কাহিনীকেও হার মানায়। হ্যাঁ, আমি তারেক জিয়ার কথা বলছি। আমি একজন লুটেরা দুর্নীতিবাজের কথা বলছি, যিনি রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। 



হতদরিদ্র গরডিয়াস ও মাইডাসের মত তারেক জিয়ার গল্পের শুরুটাও একইরকম। সে গল্প ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জির গল্প। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে নিহত হওয়ার সময় এসবই নাকি রেখে গিয়েছিলেন তারেক জিয়ার বাবা মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রই তখন জিয়াউর রহমানের পরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব নেয়। পরিবারের বাকি সদস্যরা হল তারেকের জিয়ার মাতা খালেদা জিয়া এবং ভাই আরাফাত রহমান কোকো (কেন আরাফাত জিয়া নয়, সে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই)। নিয়ম বহির্ভূত ভাবে তাদের দেয়া হয় ঢাকা সেনানীবাসের মইনুল রোডে একটি এবং অভিজাত এলাকা গুলশানে আরেকটি, মোট দুটি বাড়ি। এছাড়াও তাদের দৈনন্দিন ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় ভাতাও বরাদ্দ করা হয়েছিল। সম্পদ বলতে এসবই ছিল তাদের।  ১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আয়কর রিটার্ন দেয় তারেক জিয়া যেখানে তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছিল সর্বমোট ৪২ লাখ টাকা। এর বেশিরভাগই আবার ছিল উপহার সুত্রে পাওয়া। সেই টাকা থেকেই আজ তারেক জিয়া নয় হাজার কোটি টাকার মালিক, বাংলাদেশের চতুর্থ ধনী ব্যাক্তি (ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্যমতে)এটা প্রকাশিত সম্পদের পরিমাণ। আর অপ্রকাশিত সম্পদের সঠিক পরিমাণ একমাত্র তারেক জিয়া ছাড়া আর কেউই বলতে পারবে না। সৌদি আরবে পাচার করে দেয়া চারশটি স্যুটকেসে কি ছিল তা আজো আমাদের অজানা।    

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে বিএনপি পুনরায় রাস্ট্রক্ষমতায় আসে। ১৯৯১-১৯৯৬ সময়ের মাঝেও  মাইডাস টাচ হাতে পাননি তারেক জিয়া। এই সময়ে খুব বেশি আলোচনাতেও ছিলেন না তিনিকিন্তু ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি জামাত জোট সরকার গঠন করার পরই মূল মঞ্চে আসেন তারেক জিয়া২০০২ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হন তারেক জিয়াএটাই মনে হয় ছিল তারেক  জিয়ার  মাইডাস টাচ কেননা এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে বহুল আলোচিত হাওয়া ভবন কে  উনি ক্ষমতার  কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। দীর্ঘদিনের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মাম্নুনকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেট যার মাধ্যমে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা হয়  এভাবেই দুই বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। বলা যেতে পারে খালেদা জিয়া এসময় শুধু নামেই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, যাবতীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল তারেক জিয়ার হাতে।

বাসযাত্রী থেকে হজ্জযাত্রী পর্যন্ত,টঙয়ের দোকান থেকে শুরু করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি পর্যন্ত বোধহয় এমন কেও নেই যার কাছ থেকে তারেক জিয়া উচ্চ অঙ্কের অর্থ আদায় করেননি । যেকোন ধরণের আর্থিক বিনিয়োগ, বড় ব্যবসায়িক লেনদেন, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক চুক্তি ইত্যাদির কোনকিছুই হাওয়া ভবন তথা তারেক জিয়াকে ডিঙ্গিয়ে হওয়া ছিল  অসম্ভব।  অর্থের মাধ্যমে মন্ত্রিত্ব পাইয়ে দেওয়া,ব্যবসা পাইয়ে দেওয়া, সরকারি প্রকল্পে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ,সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি,সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ফাইল হাওয়া ভবনে নিয়ে পরীক্ষা করা ইত্যাদি সবই করেছেন তারেক জিয়া। ২০০৭ সালে তারেক জিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর হাওয়া ভবন থেকে উদ্ধার করা হয় ত্রিশটি টাকা গণনার মেশিন। এথেকেই ধারণা পাওয়া যায় কত বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন হত হাওয়া ভবনে।  দুর্নীতিতে বাংলাদেশ ২০০২-২০০৬ পর্যন্ত টানা ৫ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। নিঃসন্দেহে বলা যায় এটা ছিল তারেক জিয়ার একক নৈপুণ্যের অবদান। দুর্নীতির এই চ্যাম্পিয়নশিপে সন্দেহাতীতভাবে তিনিই ছিলেন প্রতিবারের ম্যান অব দ্য সিরিজ।    




এবার তারেক জিয়ার কিছু সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির ব্যাপারে আলোকপাত করা যাক।   

বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে গৃহীত ডিএপি-১ ও ডিএপি-২ সার কারখানার ব্যয় ৮৫৯ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। মুলত এই দুই প্রকল্প থেকেই তারেক জিয়া একাই হাতিয়ে নেন ৫০০ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ। এছাড়াও টঙ্গীতে ২৫০ মেগাওয়াট ও বড়পুকুরিয়ায় ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প,১৫৮৮.৯৫ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে পাগলা পানি শোধনাগার প্রকল্প,৯৮৭.৯৫ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে উত্তর ঢাকা পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প,৭০১ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে সিদ্ধিরগঞ্জ ২১০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (দ্বিতীয় ইউনিট),৯২৭.৫৫ কোটি টাকা সংশোধিত ব্যয়ে খুলনা ২১০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি প্রকল্প থেকে তারেক জিয়া হাতিয়ে নেন সর্বমোট দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ। 

বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে ধংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায় এদেশের বিদ্যুৎ খাত। তারেক জিয়া আর মামুনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান খাম্বা লিমিটেড মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন তারেক জিয়া। জোট সরকারের পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দকৃত ১৫ হাজার কোটি টাকার সিংহভাগই গিয়েছে তারেক জিয়া আর গিয়াসউদ্দীন আল মামুনের পকেটে। বিদ্যুতের অভাবে সেসময় দেশের শিল্পোৎপাদন মারত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। তারেক আর মামুন গংয়ের লোভের কবলে দেশের বিদ্যুৎ খাত এবং শত শত শিল্প প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হলেও তারেক-মামুনরা প্রতিনিয়ত মোটাতাজা হয়েছেন। 

২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত পুলিশ বিভাগে যত নিয়োগ হয়েছে তার ৮০ ভাগই হয়েছে টাকার বিনিময়ে এবং এই টাকার ভাগ সরাসরি তারেক জিয়া পর্যন্ত পৌছাত। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুতফুজ্জামান বাবর একথা স্বীকারও করেছেন। ২০০৪ সালে  গিয়াস উদ্দিন আল মামুন প্রতারণার মাধ্যমে গাজীপুর বন বিভাগের প্রায় ৭২ বিঘা জমি বরাদ্দ নিয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে গাজীপুর ভাওয়াল উদ্যানের পাশে এই জমি অন্যের নামে বরাদ্দ নিয়ে তারা প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ওয়ান ডেনিস মিল ও ওয়ান স্পিনিং মিল স্থাপন করেছেন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের আপত্তি এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত উপেক্ষা করে ভূমি মন্ত্রণালয় এই জমি বরাদ্দ দেয়। তৎকালীন ভূমি সচিব আজাদ রুহুল আমিন ও গাজীপুরের জেলা প্রশাসক সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে যোগসাজশে প্রতিবিঘা জমির দাম মাত্র সোয়া লাখ টাকার কিছু বেশি ধার্য করা হয়। তারপর বন কেটে গড়ে তোলা হয় টেক্সটাইল মিল। একাজের পেছনেও ছিল তারেক জিয়ার আশীর্বাদ। এছাড়াও গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ও তারেক জিয়া রেজা কন্সট্রাকশান থেকে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে।  জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট থেকে আত্মসাত করে আড়াই কোটি টাকা। সিমেন্স কোম্পানিকে টেলিটক প্রজেক্টের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্যও কয়েক কোটি টাকার ঘুষ আদায় করা হয়।  



বসুন্ধরা গ্রুপের টেলিযোগাযোগ শাখার পরিচালক হুমায়ুন কবির সাব্বির (৩০) ২০০৬ সালের ৪ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানের একটি বাসায় খুন হন। এ হত্যা মামলার প্রধান আসামী ছিল বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের ছেলে সাফায়েত সোবহান সানবীর তারেক জিয়া ১০০ কোটি টাকা ঘুষ  গ্রহনের মাধ্যমে সানবীরকে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। এমনকি পুলিশের চার্জশীট থেকেও সানবীরের নাম বাদ দেয়ার চেষ্টা করা হয় যদিও সংবাদ মাধ্যমগুলোর চাপে সেটা শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। 

গাজীপুর শহরের ছায়াবীথি এলাকায় ১০ কাঠা জমির ওপর তিনতলাবিশিষ্ট একটি আকর্ষণীয় ভবন, যার নাম খোয়াব। কাগজপত্রে জায়গা ও ভবনের মালিক গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের স্ত্রী হলেও তারেকের টাকায় মামুন এ ভবনটি তৈরি করেন। এ ভবন থেকে আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ভবনে তারেক জিয়া ও মামুন প্রায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সারারাত থেকে সকাল বেলা চলে আসতেন। সুন্দরী তরুণী,নায়িকা ও মডেল কন্যাদের প্রতি রাতেই যাতায়াত ছিল সেখানে। এলাকাবাসীদের ঠাট্টা করে বলতে শোনা যায়,তারেক রহমান সুন্দরী ললনা,নায়িকা-গায়িকা এবং মডেলদের নিয়ে রাতভর আমোদ-ফূর্তি করে জাতীয়তাবাদী আদর্শে মাতাল হয়ে খোয়াব দেখছেন।   

শুধু ধনসম্পদের প্রতি নয়, ক্ষমতার প্রতিও ছিল তারেক জিয়ার দারুণ মোহ। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য উনি সম্ভাব্য সব কিছুই করেছেন তিনি২০০১-২০০৬ সালের মাঝে দেশব্যাপী জংগী উত্থানের পিছনেও হাত ছিল তারেক জিয়ার। তার সখ্য ছিল মুম্বাইয়ের কুখ্যাত মাফিয়া ডন দাঊদ ইব্রাহীমের সাথেও। দুবাইয়ে বেশ কয়েক  বার উনি দেখাও করেন দাউদ ইব্রাহীমের সাথে। ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার উপর যে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল তার মাস্টারপ্ল্যানারও ছিলেন তারেক জিয়া। ২০০১-২০০৬ সালে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের এক জঘন্য নজির সৃষ্টি করেছিলেন তারেক জিয়া। উনি যেসব এলাকায় রাজনৈতিক সফরে যেতেন সেসব এলাকাতেই বিএনপি দলীয় অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যেত  বহুগুন। তারেক জিয়া তার নিজের এলাকা বগুড়ায় সন্ত্রাসী ও নানা ধরনের অপরাধীদের দলে আশ্রয়-প্রশ্রয়  দিয়েছেন। ওই সময়ে সংঘটিত অর্ধডজন খুনের মামলার আসামিরা বগুড়া বিএনপির নেতৃত্বে থেকে আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরছে তারেকের লোক পরিচয় দিয়েই।  

জিয়াউর রহমান দম্ভভরে বলতেন মানি ইজ নো প্রব্লেমআরও বলতেন আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করা কঠিন করে দিব ২০০১-২০০৬ সময়ে তার স্বপ্নই বাস্তবায়ন করেছেন তার ছেলে তারেক জিয়া। পুরো দেশটাকে জিম্মি করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড় আর রাজনীতিকে করেছেন কলুষিত।  
সাড়াজাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিক্স বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের এমব্যাসির একটি গোপন তারবার্তা ফাঁস করে। এতে তারেককে "দুর্নীতি ও চুরির মানসিকতাসম্পন্ন" বলে আখ্যায়িত করে। বার্তায় তারেকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়। তারবার্তায় আরও বলা হয়,তার (তারেকের) কোটি কোটি ডলারের সরকারি অর্থ চুরি এই মডারেট মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত করেছে।

এই ছিল মাইডাস টাচ হাতে পাওয়া রাজপুত্তুর তারেক জিয়ার আপাত প্রকাশিত দুর্নীতির গল্প যা রুপকথাকেও হার মানায়। অনেকের কাছেই এটা চর্বিত চর্বণ মনে হতে পারে তারপরও আরেকবার মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম। কারন দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের মেমোরি গোল্ডফিশের মত।  অতীতকে আমরা অনেক সহজেই ভুলে যাই। আর কখনো রাজনীতি করব না এই মুচলেকা দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া তারেক জিয়া আবারও রাজনীতি ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। লন্ডনে থেকে উনি অতীত ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করার মন্ত্র শুনাচ্ছেন। এখন দেশবাসীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা আবারও শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দিবে কি না? কারণ বিএনপিকে নির্বাচিত করে তারেক জিয়ার হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া এবং শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়ার মাঝে আমি কোন পার্থক্য দেখিনা সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক এই প্রত্যাশাই করি। কারণ আমাদের  একটি ভুল সিদ্ধান্তই এই সোনার বাংলাকে বহুবছর পিছিয়ে দিতে পারে। যা আমাদের কারুরই কাম্য নয়।    






তাজউদ্দীন আহমদঃ পর্দার অন্তরালের নায়ক




দীর্ঘ পথ শ্রমে ক্লান্ত। সীমান্ত থেকে সামান্য দূরে বৃটিশ আমলে তৈরি কালভার্টের উপর শরীর এলিয়ে দেন। তাঁর অবসন্ন চোখের পাতায় নেমে আসতে চায় রাজ্যের ঘুম। না, তিনি ঘুমিয়ে পড়েননি। তিনি ঘুমিয়ে পড়লে তো চলবেনা। দেশ স্বাধীন করতে, স্বাধীন দেশকে ভূমিষ্ঠ করাতে তিনি তো নিজেই ধাত্রী। তাঁর চোখে তো ঘুম শোভা পায়না। তাঁর ভাষায়, 'আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলো : একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা।' (তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে। পৃষ্ঠা-২৯১)।”  
হ্যাঁ, আমি তাজউদ্দীন আহমদের কথা বলছি। আমি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কথা বলছি। আমি একজন মহাবিপ্লবী স্বপ্নদ্রষ্টার কথা বলছি। আমি একজন অকুতোভয় নেতার কথা বলছি। মূলত তার উদ্যোগেই ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল। সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এটি ছিল এক অনন্য পদক্ষেপ। এই সরকারের সুযোগ্য নেতৃত্বেই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন এক বিস্ময়ের, যার নাম বাংলাদেশ। অতএব নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের জন্মের সাথে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে আছেন তাজউদ্দীন আহমদযতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন এই মহান মানুষটি।    
আজ তাজউদ্দীন আহমদের জীবনী লিখব না। সেই গল্প না হয় অন্যকোন দিনের জন্য তোলা থাকুক। আজ উনার জীবনের কিছু মুহূর্তের কথা বলব, কিছু খন্ডচিত্র তোলে ধরার চেষ্টা করব। এথেকেই বোঝা যাবে কত মহান ছিলেন এই মানুষটি।
১৭ই এপ্রিল, ১৯৭১। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ কে প্রধানমন্ত্রী করে গঠন করা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহন শেষ হল
মেহেরপুরের বদ্যিনাথ তলার আম্রকাননে এবার ভারতে প্রবেশের পালা। সেখান থেকেই আপাতত রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এই সরকার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়া ভারতে প্রবেশে অস্বীকৃতি জানান তাজউদ্দীন আহমদ। কারণ এতে বাংলাদেশের মর্যাদাহানি হবে। অবশেষে ভারত সরকার যথাযথ মর্যাদা সহকারে গার্ড অব অনার দিয়েই বরণ করে নেয় নবগঠিত  বাংলাদেশ সরকারকে। দেশের মর্যাদা প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এমনি আপোষহীন।   
১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয় নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের। এই বৈঠকে উপস্থিত হতে বেশ কিছুক্ষন দেরি হয়েছিল তাজউদ্দীন আহমদের। এর কারণ ছিল বাইরে পড়ে যাওয়ার মত তাঁর একমাত্র শার্টটি উনি ধুয়ে দিয়েছিলেন এবং এটি শুকাতে দেরি হয়েছিল। এতোটাই সাধাসিধে ছিল উনার ব্যক্তিজীবন। ভারতে অবস্থানকালীন সময়ে উনি থাকতেন
৮নং থিয়েটার রোডের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অফিস কক্ষের পেছনে লাগোয়া একটি কক্ষেএকটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উনি বিন্দুমাত্র অতিরিক্ত সুবিধাও গ্রহন করেননি এমনকি, ১৯৭১ সালের ২৬শে এপ্রিল উনি যখন সৈয়দ জোহরা খাতুল লিলির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তখন অলংকার হিসেবে নববধূকে দিয়েছিলেন একটি বেলী ফুলের মালা। এর বেশি কিছু দেয়ার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। নিতান্ত সাধারণ পোশাক আর মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এই অসাধারণ মানুষটির জীবনে শৌখিনতা বা বিলাস বলতে যেটুকু ছিল তা তাঁর ভাষায়- 'আমার আর কিছু না থাক চুল আঁচড়াবার বিলাস আছে। হোক সামান্য, তবুতো বিলাস।'(তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১ম খন্ড) একজন রাজনৈতিক নেতার সাধাসিধে জীবন যাপনের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল।    
২৫শে মার্চের কালোরাত্রির পর ভারতে উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার আগে তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করে যেতে পারেননি। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে উনি একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন যাতে লিখা ছিল, “সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও”এমনি দেশদরদী ছিলেন এই মানুষটি যার কাছে পরিবার পরিজনের চাইতেও দেশের স্বার্থ ছিল শত সহস্রগুণ বড়।   
ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিটি আলোচনায় তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ফাইলপত্র নিয়ে নিয়মিত হাজির হওয়া গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী, যিনি তাঁর দাবির ব্যাপারে সবসময়ই থাকতেন অনড়। ইয়াহিয়া খানও তাজউদ্দীনকে ভয় করতেন। কারণ আলোচনার টেবিলে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর, কোনো ছিটেফোঁটা আবেগও তাঁর মাঝে কাজ করত না। দূরদর্শী এই নেতা ছিলেন জাতির পিতার চরম আস্থাভাজন। তাঁর প্রতিটি মতামতকেই জাতির জনক যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে বঙ্গবন্ধু পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট যে দলীয় হাই কমান্ড গঠন করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন তাঁর অন্যতম সদস্য। জাতির পিতার এই আস্থার প্রতিদান উনি দিয়ে গেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। কর্মময় জীবনে উনি কখনোই নিজ কৃতিত্বের দাবি করেননিকর্তব্য বিবেচনা করে নিঃস্বার্থভাবে, একাগ্রচিত্তে কাজ করে গেছেন। বলেছেন, “মুছে যাক আমার নাম কিন্তু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।”  
আজ এই মহান নেতার জন্মদিন। আজ থেকে ৮৮ বছর আগে ১৯২৫ সালের ২৩শে জুলাই শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের, গজারি বনের ছায়াঘেরা, ঢাকার অদূরে কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন তাজউদ্দীন আহমদ। ৮৮তম জন্মদিনের প্রাক্কালে এই মহান নেতার প্রতি রইল শত সহস্র সালাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলী।

হে মহান নেতা, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে না ফেরার দেশে অনেক ভালো আছেন আপনি। সেখান থেকে আমাদের জন্য শুধু দোয়া করবেন, আমরা যেন আপনার আদর্শ বুকে ধারণ করে নিঃস্বার্থভাবে এই দেশের জন্য কাজ করে যেতে পারি। এই দুখী বাংলাকে আক্ষরিক অর্থেই সোনার বাংলায় পরিণত করতে পারি। নিশ্চিতভাবেই জানি এটা করতে পারলে আপনার থেকে বেশি খুশি খুব বেশি কেউ হবে না।