মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

একজন অহংকারীর পতন




পবিত্র কুরআন মাজীদে সূরা বনী ইসরাইলে আল্লাহ পাক বলেছেন, পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না। সূরা লোকমানে বলা হয়েছে, অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। অন্যান্য সব ধর্মগ্রন্থেও অহংকারকে মানবচরিত্রের একটি নিকৃষ্টতম দিক হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। কথায় বলে, অহংকার পতনের মূল। কিন্তু তারপরও অর্থ-সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা মানুশরুপী কিছু হায়েনাকে প্রায়শই অহংকারী করে তোলে। যেমনটি করেছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। 
 
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকাচৌ। চট্টগ্রামের রাউজান থেকে টানা ছয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং খালেদা জিয়ার এক সময়ের রাজনৈতিক উপদেস্টা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের রাউজান, গহিরা, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি এলাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সাথে নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী। গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুন্ঠনসহ এমন কোন হীন অপরাধ নেই যা তারা করেনি। আজ এই জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের রায় হয়েছে ফাঁসি। এর মাধ্যমে শুধু একজন ঘৃণ্য অপরাধীই সাজা পেল না, একজন দাম্ভিক-অহংকারীরও পতন হল।
সালাউদ্দিন কাদের চোধুরীই সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অহংকারী ব্যক্তি। অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলতে তার জুড়ি ছিল না। তার বাক্যবাণ থেকে রক্ষা পায়নি নিজদলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে আদালতের বিচারক পর্যন্ত। সকল নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিনিয়ত সেচ্ছাচারী ব্যবহার করে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু এর জন্য কখনোই তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। আর একারণেই বারবার দাম্ভিকতার চূড়ান্ত প্রদর্শনী দেখাতে পেরেছিলেন তিনি। আজ ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে চূর্ণ হল তার সব দম্ভ, সব অহংকার। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় সে একজন ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবেই লিপিবদ্ধ থাকবে। এর বেশি কিছু না। আসুন সালাউদ্দিন কাদের চোধুরীর অহংকারী আচরনের কিছু নিদর্শন দেখে নেয়া যাক।  
২০০১ সালে ওআইসি মহাসচিব পদে বাংলাদেশ থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয় তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার। এই উদ্যোগ ছিল বিশ্ব পরিমন্ডলে একজন যুদ্ধাপরাধীকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি হীন অপচেষ্টা মাত্র। তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামীলীগ এর বিরোধিতা করে বলেছিল  একজন যুদ্ধাপরাধী ও আন্তর্জাতিক সোনা চোরাকারবারিকে সরকার এই পদে মনোনয়ন দিয়ে বরং এই পদকে কলঙ্কিত করছে এবং আমাদের সামনে ওআইসি মহাসচিব পদ পাওয়ার সুনিচিত পথটিও সরকার হারাচ্ছে। সরকার যদি ঐ পদে ওরে বাদ দিয়ে বিএনপির মধ্যে যোগ্যতম অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয় তাহলে আমরাও সহযোগিতা করব। কিন্তু সাকা চৌধুরীর একগুয়েমি আচরণের কারণে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। সাকা চৌধুরীকে নির্বাচিত করতে প্রায় ২০০ কোটি খরচ করে লবিং করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। উপরন্তু এই ঘটনার জের ধরে মালয়েশিয়ার সাথে বন্ধুত্যে ফাটল ধরে কারণ মহাসচিব পদে মালয়েশিয়ারও প্রার্থী ছিল। মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশীদের জন্য। সাকা চৌধুরীর অহংকারের মূল্য চুকাতে হয় রাষ্ট্রের ক্ষতি করে।
পবিত্র সংসদে দাড়িয়েও একের পর কে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন সাকা চৌধুরী। সংসদে দাঁড়িয়ে সাকা চৌধুরী একবার বলেছিলেন, মাননীয় স্পীকার আমি তো *দনা হয়ে গেলাম। তার এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ  করার কথা বললে সাকা চৌধুরী বলে উঠেন, মাননীয় স্পীকার আমি আবারও *দনা হয়ে গেলাম। পঞ্চম সংশোধনী হওয়ার পর সাকা চৌধুরী সংসদে দাঁড়িয়ে এতো নোংড়া উক্তি করেন যা এখানে লিখাও সম্ভব নয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০০১ সালে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএনপি। এর জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এতোদিন জানতাম কুকুর লেজ নাড়ায়। এখন তো দেখছি লেজ কুকুড় নাড়াচ্ছে। বিগত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে সম্পদের হিসাব চাইলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেছিল ওদের কাছে কি জবাবদিহি করব ? ওদের কে তো চাকরি দিয়েছি আমরাই। ওরা আমাদেরকে জি স্যার, জি স্যার করত। এদের কথার আবার কিসের জবাব ? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য সংসদে আইন পাশ করা হলে সাকা চৌধুরী বলেছিলেন, এ আইনের নাম হওয়া উচিত ছিলো মালেকুল মউত আইন। শেখানে হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন সাকা চৌধুরী। ১/১১ পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হওয়ার সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছিলেন, ধর্ষণ যেখানে নিশ্চিত সেখানে উপভোগ করাই শ্রেয়।
মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর আসামীর কাঠগড়ায় দাড়িয়েও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একের পর এক কটুক্তি করে গিয়েছেন প্রসিকিউটর ও বিচারকদের প্রতি। এমনকি জেলখানায় থাকার সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের হয়। বিচারকাজের একদম শুরুর দিকেই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছিল, আমি রাজাকার। আমার বাপ রাজাকার। এখন কে কি করতে পারেন করেন। রায় পড়ার সময়ও সারাক্ষণই সাকা চৌধুরী হাসছিলেন এবং বিভিন্ন মন্তব্য করছিলেন। ৩ নম্বর অভিযোগ পড়ার সময় তিনি বলেন, ৩০ লাখ তো মারা গেছে। বলে দিলেই হয়, আমি ২০ লাখ মেরেছি। আরেক বার তিনি বলেন, তোমার বোনকে বিয়ে করার কথা ছিলো, সেটা বল না? হু ধানের কল চুরি করছি ঘরে ঢুকছি তারপর কি করছি বল। লাল মিয়া, সোনা মিয়া বল, পাঁচ কেটে ছয় করার দরকার? মিয়া তো ঠিকই আছে। এ সব মন্তব্য থেকেই প্রমাণিত হয় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার কৃতকর্মের জন্য বিন্দুমাত্রও অনুতপ্ত নয়। আরও প্রমাণিত হয় সে আসলে মানুষ নয়, মানুষরুপী হিংস্র নরপিশাচ।  

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন জাতি দায়মুক্ত হল অপরদিকে এই রায় হয়ে থাকল সকল অহংকারীর প্রতি এক বাস্তব শিক্ষা। পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিণতি দেখে আমাদের সবারই শিক্ষা নেয়া উচিৎ। অহংকার এবং দাম্ভিকতা পরিহার করা উচিৎ। কেননা অহংকার আসলেই পতনের মূল। আর এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
 
 
 
                  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন