রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

খুলনার জনসভায় খালেদা জিয়ার ভাষণঃ মিথ্যাচারের এক অনবদ্য প্রদর্শনী

খুলনার সার্কিট হাউজ মাঠে আঠারদলীয় জোট আয়োজিত জনসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার দেয়া ভাষণ শুনলান। কোন নতুনত্ব নেই। আছে শুধু সরকার তথা আওয়ামীলীগের প্রতি একগাদা বিষেদাগার। সেই বিষেদাগার করতে গিয়ে উনি এমন কিছু মিথ্যাচার করলেন যা উনার মত দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে কখনোই কাম্য হতে পারে না। আসুন দেখা যাক উনার বক্তব্য আসলে কতটা বাস্তবতা বিবর্জিত ছিল।

বক্তৃতার একদম শুরুতেই খালেদা জিয়া বললেন, আওয়ামীলীগ দেশের পাটশিল্প ধ্বংস করেছে। এধরণের মিথ্যাচার আমি নিকট অতীতে কোন নেতার কাছ থেকে শুনিনি। বাস্তব চিত্রটা আসলে কি?
১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জুট সেক্টর এডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট-এর আওতায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে তৎকালীন বিএনপি সরকার, যাতে বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ হতে  ২৪৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সেই চুক্তির শর্ত  মোতাবেক তৎকালীন বিএনপি সরকার স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় দেশের পাঁচটি পাটকল। এগুলো হল ময়মনসিংহ জুট মিল, বাওয়ানি জুট মিল, মনোয়ার জুট মিল, পূর্বাচল জুট মিল ও হাফিজ টেক্সটাইল। এমনকি ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ৩০ জুন বন্ধ করে দেয়া হয় এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল। একইসঙ্গে বন্ধ করা হয় খুলনার দৌলতপুর জুট মিল ও টঙ্গীর নিশাত জুট মিলআওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাট শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলতে নানা পরিকল্পনা গ্রহন করে। যার আওতায়-৫ মার্চ,২০১১ সালে পিপলস জুট মিল চালু করা হয় খালিশপুর জুট মিল নামে; ৯ এপ্রিল, ২০১১ সালে সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কওমী জুট মিল চালু করা হয় জাতীয় জুট মিল হিসেবে; ২৬ জানুয়ারি,২০১৩ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় অবস্থিত কর্ণফুলী জুট মিল ও ফোরাত-কর্ণফুলী জুট মিল চালু হয়। এছাড়া সরকার পাটচাষিদের কাছে পাটের উন্নত বীজ ও সার পৌছানোর ব্যবস্থা করেনিশ্চিত করা হয় পাটের ন্যায্য মূল্য। ফলে কৃষকরা নব উদ্যমে পাট চাষে ঝুঁকছেন। পাটের সোনালী ঐতিহ্য ফিরে আসা শুরু হয়েছে। এই সরকারের আমলেই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীবন রহস্য উদঘাটিত করছেন। পাট এখন আক্ষরিক অর্থেই আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি।

এরপর খালেদা জিয়া বললেন
বললেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশ লোক নেয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোন দেশ নাকি বাংলাদেশ থেকে লোক নিচ্ছে না। অথচ উনি মনে হয় জানেন না যে বিগত জোট সরকারের তুলনায় বর্তমানে দেশের রেমিট্যান্স বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর বেশিরভাগটাই এসেছে শ্রম রফতানি থেকে। গত সরকারের সময়ে বন্ধ হওয়া অনেক শ্রম বাজার একে একে খুলতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকারসরকারি ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো শুরু হয়েছে। অল্প টাকাতেই শ্রমিকরা এখন বিদেশ যেতে পারছেনঅচিরেই কাতার এবং সৌদি আরবেও শ্রমিক পাঠানো শুরু হবে।

খালেদা জিয়া বললেন, বিগত জোট সরকারের আমলে সীমান্তে একটা গুলিও চলে নি
বিএসএফ এর হাতে নাকি কেউ মারা যায়নি উনি এত সহজে অতীতের কথা ভুলে যান কিভাবে? বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা লিখে গুগলে সার্চ দিলেই যে কেউ দেখতে পাবে সীমান্তে কোন আমলে কতজন নিহত হয়েছে। সংখ্যাটা বলে দিচ্ছি। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে নিহত হয়েছেন ৪৩৬ জন বাংলাদেশী। আর বর্তমান সরকারের আমলে এখন পর্যন্ত সীমান্তে নিহত হয়েছেন ২৩৭ জন। 

খালেদা জিয়া বললেন, দেশে কোন বিদ্যুৎ নেই
এই সরকার নাকি জনগণকে বিদ্যুৎ দিতে পারছে না। আসুন বাস্তবতাটা জেনে নিই। বিগত জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রতিদিন ৪২০০ মেগাওয়াট। আর বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৮৭০০ মেগাওয়াট। গড়ে প্রতিদিন ৬৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে যা গত সরকারের তুলনায় দ্বিগুণ। তাছাড়া গত সরকারের আমলে তারেক জিয়ার খাম্বা দুর্নীতির কথা এখানে নাইবা তুললাম। শুধুমাত্র খাম্বা দুর্নীতির মাধ্যমেই তারেক জিয়া হাতিয়ে নিয়েছিলনে ২০০০ কোটি টাকারও বেশি।  

এরপর খালেদা জিয়া বললেন, এই সরকার কৃষকদের মূল্যায়ন করেনি, দারিদ্র্যতা কমায়নি
বিরোধদলীয় নেত্রী আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আপনার সরকারের আমলে সারের দাবিতে আন্দোলন করা কৃষকদের উপর গুলি চালানো হয়েছিল। সেচের জন্য বিদ্যুতের দাবিতে বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আর বর্তমান সরকারের গত পৌনে পাঁচ বছরে দেশের কোথাও সারের দাবিতে আন্দোলন হয়নি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের কাছেও সরকার সার পৌছে দিতে পেরেছে। সেচের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। আর তাই দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণচাইলে খাদ্য এখন বিদেশে রফতানীও করা যাবে। আর দারিদ্র্যতা বিমোচনের কথা বলছেন? দারিদ্র বিমোচনের জন্য বর্তমান সরকারের গৃহীত প্রকল্প সারা বিশ্বে উন্নয়ন মডেল হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। এই সরকারের সময়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে শতকরা দশ ভাগেরও বেশি। এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল।   

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে খালেদা জিয়া বললেন এই নির্বাচন কমিশন নাকি একটাও নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন করতে পারেনি
কি ধরণের ভিত্তিহীন মিথ্যাচার এটা ? এই সরকারের আমলে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রায় আট হাজার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোথাও কারচুপির অভিযোগ উঠেনি। এমনকি সর্বশেষ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছে। তারপরও কিভাবে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ? আপানাদের সময়ে হওয়া মাগুরা উপনির্বাচন ও ঢাকা-১০ আসনেরর উপনির্বাচনের কথা কিন্তু আমরা ভুলিনি। আপনি বললেন ভোটার তালিকায় নাকি ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আপনি ঠিক কোন আমলের কথা বলছেন তাই বুঝতে পারলাম না। আপনাদের সময়ে করা ভোটার তালিকার এক কোটি চল্লিশ লাখ ভুয়া ভোটারের কথা কিন্তু আমাদের দিব্যি মনে আছে

খালেদা জিয়া বক্তৃতায় দাবি করলেন, উনাদের সময় নাকি কোন জঙ্গীবাদ হয় নাই। সব নাকি আওয়ামীলীগ আমলে হয়েছে। তাহলে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা কি ছিল? বাংলা ভাই,শায়খ আব্দুর রহমান, মুফতী হান্নানরা কি ছিলেন? ব্রিটিশ হাই কমিশনার এর উপর বোমাহামলা কি ছিল? আদালতে বোমা মেরে বিচারক হত্যা কি ছিল? ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা কি ছিল? এইগুলো যদি আপনার চোখে জঙ্গীবাদ না হয় তাহলে তো আর কিছু বলার নেই
বিগত জোট সরকারের আমলে কোন দুর্নীতি ছিল না বলে দাবি করলেন খালেদা জিয়া। অথচ সেইসময়েই বাংলাদেশ পর পর পাঁচবার দুর্নীতিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০ তম।

পুরা বক্তৃতা জুড়ে আওয়ামীলীগের বিষেদাগার করে শেষ পর্যায়ে খালেদা জিয়া বললেন বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতিক করে না। ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে কি হিসেবে চিহ্নিত করবেন আপনি? শাহ কিবরিয়া, আইভী রহমান, আহসানউল্লাহ মাস্টার সহ হাজার হাজার আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীকে হত্যা তাহলে কি ছিল ?

খালেদা জিয়ার পুরোটা বক্তৃতা শুনে মনে হল দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই। বক্তৃতা দিতে হয় তাই দিয়েছেন। কিন্তু জনগণ এখন অনেক সচেতন। কে কি কাজ করেছে তার খতিয়ান সবারই মনে আছে। এতো তাড়াতাড়ি ভুলি কিভাবে ?


Top of Form

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন