রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৩

জাতীয় সংসদে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহারঃ উত্তাল অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম



নবম জাতীয় সংসদের চলতি আঠারতম অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন কারণে সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। প্রথমত, এই অধিবেশনের মাধ্যমেই দায়িত্ব পালন শুরু করছেন দেশের ইতিহাসের প্রথম মহিলা স্পীকার ডঃ শিরিন শারমিন চৌধুরী। নারী ক্ষমতায়নের ইতিহাসে এটা নিশ্চয়ই অনেক বড় মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন থেকে সংসদে অনুপস্থিত থাকা চারদলীয় জোটের সংসদ সদস্যদের এই অধিবেশনে যোগ দিতেই হত, অন্যথায় নব্বই কার্যাদিবসের অধিক সময় সংসদে অনুপস্থিত থাকায় তাদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যেত। তৃতীয়ত, এই অধিবেশনেই মহাজোট সরকার তাদের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট পেশ করবে। কিন্তু গত তেসরা জুন অধিবেশন শুরু হওয়ার পর এখন সবকিছু ছাড়িয়ে আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে সংসদে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার। এর প্রভাব পড়েছে অনলাইনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুক ও ব্লগসাইট গুলোতেও। অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রতিনিয়তই আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ফেসবুক ও ব্লগগুলোতে, রচিত হচ্ছে বিভিন্ন স্যাটায়ার, কৌতুক আর ক্যারিকেচার।
গত নয়ই জুন বিএনপি দলীয় সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু সরকারকে উদ্দেশ্য করে সংসদে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে চুদুরবুদুর চইলতো ন। তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে সর্বত্র। সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা সংসদেই এর প্রতিবাদ জানান এবং স্পীকারের কাছে এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জের দাবি জানান। সমালোচনা শুরু হয় ফেসবুকেও। অনেকেই এধরনের শব্দ চয়নের জন্য সাংসদ রেহানা আক্তার রানুর প্রতি বিশেদাগার করেন। চুদুরবুদুর শব্দটি অশ্লীল কিংবা অসংসদীয় কিনা তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। কলকাতার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাও এ নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট করে। অবশ্য রেহানার বলা এবারের শব্দটির মধ্যে অশ্লীল কিছু খুঁজে পায়নি আনন্দবাজার। সাংসদ রেহানা আখতারের বিষয়ে আনন্দবাজারের পর্যবেক্ষণ, তার মুখএমনিতেই বেশ লাগামছাড়া সরকারকে আক্রমণ করতে তিনি যে সব বাছা বাছা শব্দের তীর  ছোড়েন, তার একটা বড় অংশই পরে কার্যবিবরণী থেকে মুছে ফেলতে হয়। এব্যপারে জনপ্রিয় ফেসবুক ইউজার সবাক পাখি তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেন,
কৈশোরে এলাকার সব বয়সী মানুষকে একটা শব্দ খুব বেশি ব্যবহার করতে দেখতাম। শব্দটা হলো চ্যাঙ, মানে নুনুকোন কিছুতে বিরক্ত হলেই একটু টেনে বলতো চ্যাঙসুতরাং চ্যাং অশ্লীল না। এর অর্থ হচ্ছে আঁই বিরক্ত!
যাইহোক, এক চাচার চ্যাং বলার অভ্যাসটা খুব ভয়াবহ ছিলো। একদিন দেখলাম উনি খুব খ্যাপা। জিজ্ঞাসা করলাম কী হইলো চাচা? চাচায় কয়,
চ্যাঙেরে কইছি চ্যাঙ বাঁধতে, চ্যাঙে চ্যাঙের মত করি চ্যাঙ বাঁধছে, চ্যাঙ ছুঁডি যাই চ্যাঙ খায়ালাইছে।
তর্জমা : পোলারে কইছি গরু বাঁধতে, পোলা এমনভাবে গরু বাঁধছে, গরু বাঁধন ছিঁড়ে গিয়ে ধান খেয়ে ফেলছে।
ওরে খাইছে, এইবার দেখি চ্যাঙের ম্যালা অর্থ! আপনি কোনটা নিবেন?
এইবার আরেকবার মনে করিয়ে দিই চুদুরভুদুর এর কথা। নোয়াখালীতে এর আরেকটা রূপ আছে। চোদরভোদর। যা মূলত চোদা ভোদা শব্দ থেকে এসেছে। কিন্তু ব্যবহার করা হয়
গড়িমসি ধানাই পানাই এসব অর্থে। এর আরো কয়েকটি প্রতিশব্দের মধ্যে নয় চইদ্দ, নয় ছয় এবং হাংকি পাংকি অন্যতম। আরেকটা কথা। চুদুরবুদুর শব্দটি অশ্লীল কিনা এবং এটি সংসদে ব্যবহারের উপযোগী কিনা, এটা জানার জন্য কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ার দরকার নাই।
আরো একটা কথা। মতিকণ্ঠ যখন চুদুরবুদুর লেখে তখন নাউযুবিল্লাহ। রানু আপায় কইলে মাশআল্লাহ!
 
উল্লেখ্য, গত বছর রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়েও বিএনপির সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে কালনাগিনী, ডাইনি, প্রধান বিচারপতিকে পাগল ইত্যাদি অশালীন ভাষা ব্যবহার করে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমেরিকার সাদা চামড়ার এক বুড়ি শয়তান, ডাইনি, বান্দরনীকে এনে সাক্ষী বানানো হয়েছে। আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান চলে যেতে বলেছেন। কিন্তু মানুষ বলে, চশমাওয়ালা বুবুজান নৌকা নিয়ে ভারত যান। তিনি আরও বলেন, গানে বলে তু তু তু তুতুতারা, মর্জিনার মা মার্কা মারা। আর মানুষ বলে, তু তু তু তুতুতারা, শেখ হাসিনার মুখ মার্কা মারা। এছাড়াও, ২০১১ সালের ১৬ মার্চ বিএনপির সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েক মন্ত্রীকে কটূক্তি করে বক্তৃতা করেন। বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে আর কোনো কটূক্তি করা হলে জিভ কেটে ঝুলিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেন তিনি।
গত আঠারই জুন নতুন আলোচনার খোরাক জোগান বিএনপি দলীয় সংরক্ষিত আসনের আরেক সাংসদ শাম্মী আখতার। উনি সংসদে  তাঁর বক্তব্যে কবি হেলাল হাফিজের যার যেখানে সময় কবিতাটির একাংশ পাঠ করেন। কবিতার শেষ লাইন দুটি ছিল,
রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি,
আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি।
তাঁর এই বক্তব্যের পরপরই আবারো ঝড় উঠে ফেসবুক এবং ব্লগগুলোতেএধরনের বক্তব্য হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে সচেতন প্রতিটি  মানুষকেই। সংসদের মত পবিত্র স্থানে দাঁড়িয়ে এধরনের অশোভনীয় শব্দ ব্যবহারের কারণে শাম্মি আক্তারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন সবাই। ব্লগার অঙ্কনের সাতকাহন সামহোয়্যার ইন ব্লগ এ লিখেন
ছোটবেলায় যদি অতিরিক্ত কোন দুষ্টামি বা কোন বড় ধরনের অঘটন ঘটিয়ে ফেলতাম তখন ই আমার জান্নাত বাসী নানা আমাদের বলতেন সালারা চুদুর-বুদুর  কর । তাই চুদুর বুদুর কথাটাকে হালকা ভাবে ই নিয়েছিলাম । কিন্তু গত কাল যখন আবার বিরোধী দলীয় আরেক নারী সাংসদ শাম্মি আক্তার মহান সংসদে দড়িয়ে কবি হেলাল হাফিজ এর কবিতা যার যেখানে জায়গা এর শেষ পংক্তি  আমিও গ্রামের পোলা চুত্‌মারানি গাইল দিতে জানি  আউরালেন তখন কেন যানি আমার নিজের প্রতি নিজের ই ঘৃনা জন্মলো । হয়রে কপাল এ কোন দেশে আমি জন্মেছিলাম । একজন সাংসদের নূন্যতম সেই জ্ঞান টুকু নেই যে কবিতা টি আমি আউরাচ্ছি তার শিরোনাম টা কি ? তাই আমার প্রশ্ন আমরা জাতি হিসেবে কি ক্রমানয়ে ই কি মেধা শূন্য হয়ে যাচ্ছি ? এই যদি হয় একজন সাংসদের জ্ঞানের নমুনা তা হলে আমাদের জাতির জ্ঞানের নমুনা কি হবে ? সংসদের কার্যকরী প্রতিটি সভায় প্রতিটি মিনিটে কত টাকা খরচ হচ্ছে সে হিসেব বুঝি মাননীয় সাংসদ নিজেও রাখেন না। আর তাই সংসদের মূল্যবান সময়ে দেশের সব মাথাগুলো দুলেদুলে কবিতা শোনেন। জনগণের রক্ত-ঘাম ঝড়ানো পয়সার এরচে সর্বোত্তম ব্যবহার আর কি হতে পারে!
আরেক ফেসবুক ইউজার জিনিয়া জাহিদ লিখেন,
জাতীয় সংসদের এইসব অধিবেশনকে অবিলম্বে ১৮+ ঘোষিত করা উচিত। কারণ, অন্তত সুরুচিপূর্ণ জনগণ রেটিং দেখে তাদের সন্তানদের হিংসা, গালিগালাজ, নোংরামি, কুরুচির হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে সমর্থ হবে।
শাম্মী আক্তার নামটিই যেন অনলাইনে এখন গালিতে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক ইউজার শাম্মী হক তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেন,

ওরে আমারে কেউ বাঁচাও....
ফেবু তে ঢুকলেই সবার স্ট্যাটাসে শাম্মী শাম্মী কইয়া চিল্লা পাল্লা দেখতাছি,সাথে গালি তো আছেই।
এই প্রথম বারের মতো নিজের নাম নিয়া খুব আফসোস লাগতাছে।ইচ্ছা করতাসে নামটা পাল্টাই।
কোন উপায় আছে কি?

বিএনপি দলীয় আরেক মহিলা সাংসদ নীলুফার ইয়াসমিন মনি একুশে জুন সংসদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের প্যারোডী করে বক্তব্য দেন। এটা নিয়েও ব্যাপক সমালোচন হয় ফেসবুকে।  জনপ্রিয় ফেসবুক ইউজার মহামান্য কহেন লিখেন,
৭-ই মার্চের ভাষনের প্যারোডি করেছেন বিএনপির সাংসদ নিলোফার মনি চৌধুরী। তাও আবার খোদ সংসদে দাঁড়িয়ে। অথচ এ ভাষন স্বাধীনতার প্রথম আহবান। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মুক্তির প্রথম প্রহরের সনদ।
আজ যদি সে ভাষনের প্যারোডি করা যায়, তাহলে বুঝতে হবে তাদের কাছে এই রাষ্ট্রের কোন মূল্য নেই। স্বাধীনতার মূল্য নেই। অবশ্য যে জাতির কাছে নির্বাচন মানে উৎসব, রাজনৈতিক অধিকার সচেতনতা নয়। দেশের ভালো-মন্দ দেখভালের দায়িত্ব নয়। সে জাতির পুর্ব পাকিস্তান নামে ফিরে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আজকের সংসদ অধিবেশন এ দেশের জন্য একটা কালো দিন। পুর্ব পাকিস্তানের দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়ার চিহ্ন মাত্র। কিছু মানুষ প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। ৭১'এর ন্যায় তাদেরও বুটের নীচে আবারো চাপা পড়তে হবে।



উল্লেখ্য সাংসদ নীলুফার ইয়াসমিন মনি টকশো তেও একবার মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তখনও এটি নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
বিরোধী দল যোগ দেওয়ায় জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন যে প্রাণবন্ত হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অধিবেশনের প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং উৎসাহও বেড়েছে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশন প্রতিপক্ষহীন খেলার মাঠে একতরফা গোল করার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গোলের সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, খেলোয়াড়ের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণিত হয় না।সংসদে এখন ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্বভাবতই সবার প্রত্যাশা ছিল, সংসদে বাজেটের চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। বিরোধী দলের সাংসদেরা বাজেটের দুর্বলতা ও ত্রুটিগুলো তুলে ধরবেন, জবাবে সরকারি দলের সাংসদেরা তাঁদের যুক্তি খণ্ডনে সচেষ্ট থাকবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাজেট আলোচনায় এ নিয়েই কথাবার্তা কম। উভয় দলের সাংসদেরা বাজেট বক্তৃতার সুযোগে নিজ নিজ দলের মহিমা প্রচার করছেন এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করছেন। কোনো কোনো সাংসদ সংসদীয় রীতিনীতি না মেনে অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করতেও দ্বিধা করছেন না। সাংসদেরা ভুলে যান, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং পরস্পরকে গালাগাল করে তাঁরা যে সময় নষ্ট করছেন, তার পুরো ব্যয় বহন করা হয় জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে। জনগণ তাঁদের সংসদে পাঠিয়েছেন আইন প্রণয়নের জন্য, জনগণের অভাব-অভিযোগ ও দুঃখ-কষ্টের কথা বলতে। কিন্তু সাংসদেরা দলীয় স্বার্থে এতটাই অন্ধ যে তাঁদের ওপর অর্পিত সেই দায়িত্ব তাঁরা বেমালুম ভুলে যান।


Top of Form
Bottom of Form





  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন