নাহ,
এভাবে চলতে পারে না। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। নিজের মনে মনে এই কথা গুলোই
বলছেন রহিম মিয়া। রাগে নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে তার। আজ বিকালের
মাঝে ঢাকায় তিন ট্রাক মাছ পাঠানোর কথা। ভাড়া করা ট্রাক বাড়ির সামনে চলেও
এসেছে। ফিশারীর পুকুরে মাছও আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। তিলে তিলে পরিশ্রম করে
এই ফিশারী গড়ে তুলেছেন তিনি। নিজের সঞ্চয়ের প্রায় পুরোটাই বিনিয়োগ করেছেন
এতে। নিয়মিত যত্ন নেয়ায় মাছের উৎপাদনও হয়েছে খুব ভালো। কিন্তু মাছ ধরার
জন্য পুকুরে জাল ফেলতে গিয়েই পড়লেন বিপত্তিতে, যে বিপদ তাকে তাড়া করে ফিরছে
অনেকদিন ধরে। কিন্তু কেন? এর উত্তর পেতে হলে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যেতে হবে
বেশ কয়েকবছর আগে।
বাবার মৃত্যুর পর ভাগ বাটোয়ারা করে আলাদা হয়ে
যায় দুই ভাই- রহিম মিয়া ও করিম মিয়া। সৎ বড় ভাই করিম মিয়া অনেক বঞ্চিত করে
রহিম মিয়াকে। ভাল ভাল জমি সব নিজেই নিয়ে নেয়। রহিম মিয়ার কপালে তেমন কিছুই
জোটেনা। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন রহিম মিয়া। কঠোর পরিশ্রম করা শুরু
করেন তিনি। আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে তার। নিজের ঘোর বিপদের
দিনে আশেপাশের তেমন কেউই খোজ খবর নেয়নি। কিন্তু যখনই একটু উন্নতির মুখ
দেখলেন তখন থেকেই শুরু হল ঝামেলা।
প্রথম ঝামেলা দেখা দেয় যেদিন
রহিম মিয়া নিজের পাওয়ার টীলারটি নিয়ে ক্ষেতে প্রথমবারের মত চাষ করতে যান
সেদিন। ততদিনে তার অবস্থার বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বেশ কিছু জমি জমাও
কিনেছেন। লাঙল দিয়ে চাষ করতে অনেক সময় লাগে বিধায় ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে উনি
একটা পাওয়ার টীলার কিনেন। ঋণের টাকা শোধ করতে হবে এই চিন্তা থেকে আশেপাশের
কিছু জমিও বর্গা নিয়েছেন। এক সুন্দর সকালে উনি পাওয়ার টীলারটি নিয়ে গেলেন
ক্ষেতে চাষ করতে। গিয়ে দেখেন তার আগেই ক্ষেতে এসে হাজির গ্রামের গোটা দশ
লোক। সাথে স্কুলের মাস্টার সাবও আছেন। রহিম মিয়া হাজির হতেই মাস্টার সাব
জানালেন তারা গ্রামের ‘পরিবেশ’ কমিটির লোক। পাওয়ার টীলার দিয়ে জমি চাষ করলে
গ্রামের পরিবেশ নস্ট হবে। পাওয়ার টীলার এর শব্দে শব্দদূষন হবে। অতএব
পাওয়ার টীলার দিয়ে চাষ করা যাবে না, আগেরমত লাঙল দিয়েই করতে হবে। রহিম
মিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। অনেক করে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু
পরিবেশ কমিটি কিছুতেই বুঝে না। উপরন্তু তারা গ্রাম্য সালিশের ভয় দেখাল।
অবশেষে মাস্টার সাব কে আড়ালে ডেকে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললেন রহিম মিয়া।
কিছুক্ষণ কথা বলেই ‘ম্যানেজ’ করে ফেললেন উনাকে। সেচের জন্য পাম্প দিয়ে পানি
তোলার সময় এবং ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের সময়ও একইভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে
হয়েছে পরিবেশ কমিটিকে।
ভবিষ্যতের কথা ভেবে বেশ কয়েক বছর আগে
বাড়ির চারপাশের অনেকগুলো মেহগনি গাছের চারা লাগিয়েছিলেন রহিম মিয়া। বাড়ি
পাকা করার সময় তার কাঠের দরকার হল। উনি গেলেন তার গাছ কাটতে। আবারও সেই
গোটা দশ লোক এসে হাজির। মাস্টার সাবও আছেন। এবার উনি জানালেন তারা
‘গাছরক্ষা’ কমিটির লোক। এভাবে তো গ্রামের গাছ কেটে ফেলা ঠিক না। পরিবেশ
নস্ট হবে যে। রহিম মিয়া অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলেন। এটাও বললেন যে যতগুলো
গাছ কাটবেন তার দশগুণ লাগাবেন। কিন্তু না। ‘গাছরক্ষা’ কমিটির লোক এসব বুঝতে
রাজিনা। তাই মাস্টার সাবকে আড়ালে ডেকে নিয়ে আবারও ‘ম্যানেজ’ করতে হল
‘গাছরক্ষা’ কমিটিকে।
ফিশারী করার শুরুতেও একই ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল
রহিম মিয়াকে। ফিশারী ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় রহিম মিয়া ঠিক করলেন মাছের চাষ
করবেন। সড়কের ধারে তার তিন বিঘার একটা জমিও আছে। ফিশারীর জন্য চমৎকার
জায়গা। যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে মাছ চাষের উপর প্রশিক্ষন নিলেন তিনি।
এককালীন কিছু ঋণও নিলেন। কিন্তু পুকুর কাটতে গিয়েই পড়লেন বিপত্তিতে। আবারও
সেই গোটা দশ লোক। এবার তারা এসেছে ‘ফসলি জমিরক্ষা’ কমিটির নামে। মাস্টার
সাব বললেন ফসলি জমি নস্ট করে মাছ চাষ করা যাবে না। পরিবেশ নস্ট হবে। রহিম
মিয়া অযথাই বুঝানোর চেষ্টা করলেন। এটাও বললেন যে ফিশারী করলে গ্রামের
অনেকের কাজের সুযোগ হবে। কিন্তু পন্ডশ্রম। তাই ‘ফসলি জমিরক্ষা’ কমিটিকেও
‘ম্যানেজ’ করতে হল।
সেই ফিশারীর মাছ তোলার জন্য আজ যখন জাল ফেলতে
যাবেন তখন আবারও এসে হাজির ওই গোটা দশ লোক। এবার তাদের কমিটির নাম
‘মাছরক্ষা’ কমিটি। একসাথে এত মাছ তারা কিছুতেই ধরতে দিবেন না। এতে নাকি
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। আর এবার যেহেতু অনেক বড় প্রকল্প তাই তারা
‘ম্যানেজ’ও হলেন না অল্পতে।
রহিম মিয়া ঠিক করলেন এভাবে আর না।
গ্রামের মানুষ এখন শিক্ষিত ও সচেতন হয়েছে। উনি সবাইকে খোলে বললেন সব কথা।
মুখোশ উন্মোচিত হল ‘ম্যানেজ’ কমিটির। শেষ পর্যন্ত শান্তিতে মাছ ধরার জাল
ফেলতে পারলেন তিনি। ধীরে ধীরে উন্নতিও করলেন অনেক। অতঃপর রহিম মিয়া সুখে
শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন।
পাদটীকাঃ সে এক দেশ ছিল ভাই, সে এক
দেশ ছিল। ষোল কোটি মানুষের সেই দেশে শ’খানেক লোক ছিল। দেশের তেল, গ্যাস,
খনিজ সম্পদ, বন্দর, বিদ্যুৎ, পাহাড়, পর্বত, বনভূমি, পরিবেশ সবকিছু রক্ষার
দায়িত্ব তারা নিজেরাই কাঁধে তোলে নিয়েছিল। এর জন্য তারা একটি কমিটিও
বানিয়েছিল। সেই কমিটি আবার কথায় কথায় আন্দোলন, অনশন, লং মার্চ, শর্ট এপ্রিল
এসবও করত। সে এক দেশ ছিল ভাই!
বাবার মৃত্যুর পর ভাগ বাটোয়ারা করে আলাদা হয়ে যায় দুই ভাই- রহিম মিয়া ও করিম মিয়া। সৎ বড় ভাই করিম মিয়া অনেক বঞ্চিত করে রহিম মিয়াকে। ভাল ভাল জমি সব নিজেই নিয়ে নেয়। রহিম মিয়ার কপালে তেমন কিছুই জোটেনা। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন রহিম মিয়া। কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করেন তিনি। আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে তার। নিজের ঘোর বিপদের দিনে আশেপাশের তেমন কেউই খোজ খবর নেয়নি। কিন্তু যখনই একটু উন্নতির মুখ দেখলেন তখন থেকেই শুরু হল ঝামেলা।
প্রথম ঝামেলা দেখা দেয় যেদিন রহিম মিয়া নিজের পাওয়ার টীলারটি নিয়ে ক্ষেতে প্রথমবারের মত চাষ করতে যান সেদিন। ততদিনে তার অবস্থার বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বেশ কিছু জমি জমাও কিনেছেন। লাঙল দিয়ে চাষ করতে অনেক সময় লাগে বিধায় ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে উনি একটা পাওয়ার টীলার কিনেন। ঋণের টাকা শোধ করতে হবে এই চিন্তা থেকে আশেপাশের কিছু জমিও বর্গা নিয়েছেন। এক সুন্দর সকালে উনি পাওয়ার টীলারটি নিয়ে গেলেন ক্ষেতে চাষ করতে। গিয়ে দেখেন তার আগেই ক্ষেতে এসে হাজির গ্রামের গোটা দশ লোক। সাথে স্কুলের মাস্টার সাবও আছেন। রহিম মিয়া হাজির হতেই মাস্টার সাব জানালেন তারা গ্রামের ‘পরিবেশ’ কমিটির লোক। পাওয়ার টীলার দিয়ে জমি চাষ করলে গ্রামের পরিবেশ নস্ট হবে। পাওয়ার টীলার এর শব্দে শব্দদূষন হবে। অতএব পাওয়ার টীলার দিয়ে চাষ করা যাবে না, আগেরমত লাঙল দিয়েই করতে হবে। রহিম মিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। অনেক করে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পরিবেশ কমিটি কিছুতেই বুঝে না। উপরন্তু তারা গ্রাম্য সালিশের ভয় দেখাল। অবশেষে মাস্টার সাব কে আড়ালে ডেকে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললেন রহিম মিয়া। কিছুক্ষণ কথা বলেই ‘ম্যানেজ’ করে ফেললেন উনাকে। সেচের জন্য পাম্প দিয়ে পানি তোলার সময় এবং ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের সময়ও একইভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়েছে পরিবেশ কমিটিকে।
ভবিষ্যতের কথা ভেবে বেশ কয়েক বছর আগে বাড়ির চারপাশের অনেকগুলো মেহগনি গাছের চারা লাগিয়েছিলেন রহিম মিয়া। বাড়ি পাকা করার সময় তার কাঠের দরকার হল। উনি গেলেন তার গাছ কাটতে। আবারও সেই গোটা দশ লোক এসে হাজির। মাস্টার সাবও আছেন। এবার উনি জানালেন তারা ‘গাছরক্ষা’ কমিটির লোক। এভাবে তো গ্রামের গাছ কেটে ফেলা ঠিক না। পরিবেশ নস্ট হবে যে। রহিম মিয়া অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলেন। এটাও বললেন যে যতগুলো গাছ কাটবেন তার দশগুণ লাগাবেন। কিন্তু না। ‘গাছরক্ষা’ কমিটির লোক এসব বুঝতে রাজিনা। তাই মাস্টার সাবকে আড়ালে ডেকে নিয়ে আবারও ‘ম্যানেজ’ করতে হল ‘গাছরক্ষা’ কমিটিকে।
ফিশারী করার শুরুতেও একই ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল রহিম মিয়াকে। ফিশারী ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় রহিম মিয়া ঠিক করলেন মাছের চাষ করবেন। সড়কের ধারে তার তিন বিঘার একটা জমিও আছে। ফিশারীর জন্য চমৎকার জায়গা। যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে মাছ চাষের উপর প্রশিক্ষন নিলেন তিনি। এককালীন কিছু ঋণও নিলেন। কিন্তু পুকুর কাটতে গিয়েই পড়লেন বিপত্তিতে। আবারও সেই গোটা দশ লোক। এবার তারা এসেছে ‘ফসলি জমিরক্ষা’ কমিটির নামে। মাস্টার সাব বললেন ফসলি জমি নস্ট করে মাছ চাষ করা যাবে না। পরিবেশ নস্ট হবে। রহিম মিয়া অযথাই বুঝানোর চেষ্টা করলেন। এটাও বললেন যে ফিশারী করলে গ্রামের অনেকের কাজের সুযোগ হবে। কিন্তু পন্ডশ্রম। তাই ‘ফসলি জমিরক্ষা’ কমিটিকেও ‘ম্যানেজ’ করতে হল।
সেই ফিশারীর মাছ তোলার জন্য আজ যখন জাল ফেলতে যাবেন তখন আবারও এসে হাজির ওই গোটা দশ লোক। এবার তাদের কমিটির নাম ‘মাছরক্ষা’ কমিটি। একসাথে এত মাছ তারা কিছুতেই ধরতে দিবেন না। এতে নাকি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। আর এবার যেহেতু অনেক বড় প্রকল্প তাই তারা ‘ম্যানেজ’ও হলেন না অল্পতে।
রহিম মিয়া ঠিক করলেন এভাবে আর না। গ্রামের মানুষ এখন শিক্ষিত ও সচেতন হয়েছে। উনি সবাইকে খোলে বললেন সব কথা। মুখোশ উন্মোচিত হল ‘ম্যানেজ’ কমিটির। শেষ পর্যন্ত শান্তিতে মাছ ধরার জাল ফেলতে পারলেন তিনি। ধীরে ধীরে উন্নতিও করলেন অনেক। অতঃপর রহিম মিয়া সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন।
পাদটীকাঃ সে এক দেশ ছিল ভাই, সে এক দেশ ছিল। ষোল কোটি মানুষের সেই দেশে শ’খানেক লোক ছিল। দেশের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বন্দর, বিদ্যুৎ, পাহাড়, পর্বত, বনভূমি, পরিবেশ সবকিছু রক্ষার দায়িত্ব তারা নিজেরাই কাঁধে তোলে নিয়েছিল। এর জন্য তারা একটি কমিটিও বানিয়েছিল। সেই কমিটি আবার কথায় কথায় আন্দোলন, অনশন, লং মার্চ, শর্ট এপ্রিল এসবও করত। সে এক দেশ ছিল ভাই!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন