শুক্রবার, ২৪ মে, ২০১৩

সেলাই দিদিমনিদের দুঃখগাথা

আজ চারদিন হলো আমার মেয়েটার কাছ থেকে আব্বা ডাক শুনিনা। আমার মেয়ে তরু, মাত্র তিন বছর বয়স। এত আহ্লাদী হয়েছে আমার মেয়েটা, আমাকে না দেখে ঘুমাতেই পারে না। ওর জন্যই তো গার্মেন্টস এর কাছেই একটা ঘর ভাড়া নিতে হল যেন একসাথে থাকতে পারি। চার হাজার টাকা বেতনের মধ্য থেকে বারশো টাকা ঘর ভাড়ায় চলে যাওয়ার পর মাস চালাতে খুব কস্ট হয়। তারপর ও সারাদিন গার্মেন্টস এর কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে যখন মেয়ের মুখ দেখি তখন সব কস্ট দূর হয়ে যায়। আচ্ছা, তরু কি চারদিন ধরে না ঘুমিয়েই আছে, ও তো আমাকে না দেখে ঘুমাতেই পারে না।

ভালোবাসার টানে নিজের পরিবার ছেড়ে আমার কাছে চলে এসেছিল তরুর মা। দুবার ম্যাট্রিক ফেল করা একটা বেকার ছেলের জন্য কেন যে সে পাগল হয়েছিলো আল্লাই জানে। ওর মুখের দিকে তাকিয়েই আমি সব কস্ট ভুলে গিয়েছিলাম। গার্মেন্টস এর ফোরম্যান এর চাকরি করে দিব্যি চলে যাচ্ছিল আমাদের দিন। তরুকে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার। আচ্ছা, ওদের কে কি আর কখনোই দেখতে পাব না?

গত চারদিন ধরে রাপা প্লাজার সিড়ি ঘরে আটকে আছি আমি সহ আরো সাতজন। আমার পায়ের উপর পড়ে আছে একটা পিলার, একটু ও নড়তে পারছিনা। প্রথম দিকে খুবই ভয় পেয়েছিলাম সবাই। অনেক কান্নাকাটি আর চিৎকার করেছি উদ্ধার পাবার জন্য। না, আমাদের আর্তনাদ বিধাতার কাছে পৌঁছে নি। আমরা তো ছোটলোক, আমাদের আর্তনাদ স্রষ্টার কাছে এত সহজে পৌঁছায় না। একে একে সবাই চলে যাচ্ছে না ফেরার দেশে। সবার শেষে গেল কামাল। আমার হাত ধরে বলে গেলো বেচে থাকলে তার পংগু বাবাকে যেন আমি দেখে রাখি। আচ্ছা, আমারও তো যাবার সময় হয়ে এলো,তরু আর তরুর মাকে দেখে রাখার কথা আমি কাকে বলে যাব?

গার্মেন্টস গুলোয় নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে, তবু আমাদের মত শ্রমিকরা শুধু পেটের দায়ে এখানে কাজ করে। আমরা নাকি দেশের ফরেন রিজার্ভ বাড়াই, অথচ আমাদের রিজার্ভের খাতা সবসময় শুন্যই থাকে। এই ঘটনা নিয়ে কিছুদিন অনেক আলোচনা হবে, অনেক মিটিং মিছিল আর রাজনীতি হবে। তারপর কিছুদিন পর সবাই ভুলে যাবে আমাদের মত ছোটলোকদের কথা। আমার তরু আর তরুর মা কে দেখার কেউ থাকবে না। আল্লাহ তুমিই ওদের দেখো, আমাদের তো তুমি ছাড়া আর কেউই নেই।

আর ভাবতে পারছিনা। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। ওইতো কামাল আমাকে ডাকছে। আমাকে মাফ দিস তরু, আমাকে মাফ করে দিও তরুর মা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন