বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৩

রুপান্তিরা এমনই হয়

১)

অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝড়ছে রুদ্রর চোখ বেয়ে। পুরুষ মানুষের কাদতে নেই। সে নিজেও কাদেনি কখনো। ছেলেবেলায় যখন তার পোষা টিয়া টা খাচা ভেংগে উড়ে গিয়েছিল, খুব কস্ট পেয়েছিল। তখনো কাদে নি সে। কিন্তু আজ?

বাবা, মা, বড়দা অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েছে। বন্ধুরাও এসেছিল সান্তনা দিতে। তবু কান্না থামে নি। থামবে কিভাবে? তিন তিনটি বছর। দিনের হিসেবে এক হাজার দিনেরও বেশী। ঘন্টার হিসেবে? না, আর হিসেব করতে পারে না। মন ফিরে যায় তিন বছর আগে।

ফেসবুকে নতুন একাউন্ট খুলেছে। সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ায় ঘরকুনো রুদ্রর অফুরন্ত অবসর। সময় কাটানোর জন্য ফেসবুকই ভরসা। হঠাৎ একদিন রুপান্তি নামের একজনের ফ্রেন্ডশীপ রিকুয়েস্ট আসলো। ফেক প্রফাইল কিনা ভাবতে ভাবতেই এক্সেপ্ট অপশানে ক্লিক পড়ে গেল।

"কি মশাই, নিদ্রা পাখি কি উড়াল দিয়েছে? ঘুমাবেন না? "
চ্যাটবক্সে রুপান্তির টেক্সট। কি এক অজানা ভালো লাগায় ছেয়ে গেল রুদ্রর মন। সেই থেকে শুরু। তারপর কত সময় যে কাটলো রুপান্তির সাথে চ্যাট করে। আস্তে আস্তে জানা হয়ে গেল দুজনের সব কথাই। হল ফোন নম্বর বিনিময়। ভাবনাগুলো কিভাবে জানি সব মিলে যায় রুপান্তির সাথে। রুপান্তিও এবার এইচএসসি দিয়েছে, ভিকারুননিসার দুর্দান্ত ছাত্রী। টার্গেট মেডিকেল। এদিকে রুদ্রর ইচ্ছা বুয়েটে পড়ার। ভর্তি পরীক্ষার প্রিপারেশন আর রুপান্তিকে নিয়ে ভাবা। সময় পেলেই চ্যাট, মাঝে মাঝে ফোনে অল্প কথা বলা। অসম্ভব ভালো লাগার মধ্য দিয়ে কাটতে লাগলো সময়। এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। দুইজনই গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েছে। এই আনন্দে সাহস করে চ্যাটে রুদ্র বলেই ফেলল,
"একদিন দেখা করবে রুপান্তি ? তোমাকে না খুব দেখতে ইচ্ছা করে "
অনেকক্ষন পর রুপান্তির রিপ্লাই,
"পরশুদিন, বিকাল পাচটা,বসুন্ধরা সিটি। একদম দেরি করবে না সোনা। "
নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছে না রুদ্রর। এতো সহজে রুপান্তি রাজি হবে তা ভাবতেও পারেনি। তারপরই সমস্যার কথা মনে পড়লো। দুরে কোথাও একা কখনো যায়নি রুদ্র। এটা তো সুদূর ঢাকা।

মায়ের কাছে কখনো কিছু গোপন করে না রুদ্র। একমাত্র আশা হিসেবে মাকেই সব খোলে বলল। সব শুনে অনেকক্ষণ রুদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল মা। হয়তো ছেলের চোখে ভালোবাসার গভীরতা খুজলেন। হেসে বললেন,
"ঠিক আছে বাবা যা। তোর বাবাকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার। "

মায়ের আশির্বাদ সাথে নিয়ে জীবনে প্রথমবারের মত খুলনা থেকে একা ঢাকা আসলো রুদ্র। বসে আছে বসুন্ধরা সিটির একটি রেস্টুরেন্টে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিফটের দিকে। কখন আসবে রুপান্তি। অবশেষে আসল রুপান্তি। রুদ্রর বুকে খরস্রোতা পদ্মার ঢেউ তুলে পাশে এসে বসল। গল্প করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেল টেরই পেল না। সারাজীবন একসাথে থাকার ওয়াদা করে দুজন ফিরে গেল নিজেদের ঠিকানায়।

পড়াশোনায় আরো মনযোগী হল রুদ্র। বুয়েট যে তার চান্স পেতেই হবে। রুপান্তিকে যে সে কথা দিয়েছে।

কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার পেল রুদ্র। চান্স পেল বুয়েটের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টে। এদিকে রুপান্তিও চান্স পেয়েছে ডিএমসি তে। শুরু হল দুজনের নতুন জীবন। লুকিয়ে লুকিয়ে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মান অভিমান, খুনসুটি। এযেন উথাল পাথাল প্রেমের গীতিকাব্য। দেখতে দেখতে কেটে গেল তিন বছর। রুদ্রর দু চোখে শুধুই সুখসপ্ন। রুপান্তিকে সাথে নিয়ে আজীবন সুখের তরীতে ভেসে বেড়ানোর সপ্ন।

গত দুইদিন ধরে ফেসবুক একাউন্ট টি ডিএক্টিভেট ছিলো রুপান্তির। পাওয়া যাচ্ছিল না ফোনেও। তারপর আজ বিকেলে ফোন করে রুপান্তি যা বলল তা এরকম,
"আমার বাসা থেকে বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার পক্ষে ফ্যামিলির ডিশিসানের বাইরে যাওয়া সম্ভব না। আমাকে যদি রিয়েলি লাভ করে থাক, তাহলে ভুলে যাও আমাকে। "

এরপর থেকেই কাঁদছে রুদ্র। এই কান্নাই যে তার বাকি জীবনের সম্বল।
(এটা কোন গল্প নয়, সত্য ঘটনা। আচ্ছা রুপান্তিরা কেন এমন হয়)

২)
শেষটা তাহলে এভাবেই লিখা ছিল। মনিটরে ভেসে থাকা রুপান্তির শেষ ছবিটার দিকে তাকিয়ে এই কথাটিই ভাবছে রুদ্র। নিজের পিসিতে থাকা রুপান্তির সব ছবিই ডিলিট করে দিয়েছে সে,ডিলিট করে দিয়েছে মোবাইলের ইনবক্সে থাকা সব মেসেজও।শুধু মুছতে পারছেনা নিজের সমস্ত অস্তিত্যের সাথে মিশে থাকা রুপান্তির সৃতি্গুলো। তাই নিজেকেই শেষ করে দিবে সে। বিষ হাতে অপেক্ষা করছে রুদ্র,কখন শেষ হবে গান,
"যেতে চাইলে কাউকে ধরে রাখা যায়না
মন ছুটলে তাকে আর ফেরানো যায়না,
আমাকে ভুলে যদি সুখে থাকা যায়
রুপান্তি,তোমাকে জানাই বিদায়।"
(ফিরে এসো রুপান্তি,রুদ্রর জীবন ধংস করে দেয়ার অধিকার কেউ তোমাকে দেয়নি)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন